পাঁচ প্রকল্পের ‘গ্রেস পিরিয়ড’ শেষের পথে, চাপ বাড়বে অর্থনীতিতে

পাঁচ প্রকল্পের ‘গ্রেস পিরিয়ড’ শেষের পথে, চাপ বাড়বে অর্থনীতিতে

পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্প ও নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণে গৃহীত প্রকল্পসহ দেশের বৃহৎ পাঁচ প্রকল্পের ‘গ্রেস পিরিয়ড’ শেষ হওয়ার পথে। এই পিরিয়ড শেষ হলেই প্রকল্পগুলোর জন্য গ্রহণ করা ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ শুরু করতে হবে সরকারকে। এরই মধ্যে রিজার্ভ নিয়ে চাপের মধ্যেই ঋণ পরিশোধের দায় বেড়েছে। এর সঙ্গে পাঁচ বৃহৎ প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষে বর্ধিত ঋণ দায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যকে আরো চাপে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটি নির্মাণ হচ্ছে চীনের ২৬০ কোটি ডলার ঋণ অর্থায়নে। ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ শতাংশ। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ হিসেবে আছে আরো দশমিক ২৫ শতাংশ। প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে নির্ধারিত পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। তবে এখনো এর ঋণ পরিশোধ শুরু হয়নি। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে ১৫ বছর ধরে এ ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে সরকারকে।

ঢাকা পাওয়ার নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণে গৃহীত প্রকল্পেরও গ্রেস পিরিয়ড আগামী মাসেই শেষ হচ্ছে। এরপর প্রকল্পের জন্য নেয়া ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু হবে। শেষ হতে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন (পিইডিপি-৪) প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ডও। 

এছাড়া আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বৃহৎ প্রকল্পগুলোর গ্রেস পিরিয়ড আগামী দুই বছরের মধ্যে শেষ হতে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে যাচ্ছে সরকারের ঋণ পরিশোধের দায়ও। 

যদিও সরকারের ঋণ দায় এরই মধ্যে অর্থনীতিবিদদের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় ছিল ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন (৩০৬ কোটি) ডলার। আগের দুই অর্থবছরেও তা ৩ বিলিয়নের ঘরেই ছিল।

কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন (৪৭০ কোটি) ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে শুধু সুদই পরিশোধ করতে হয়েছে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি।

রিজার্ভ নিয়ে চাপের মধ্যেই ঋণ পরিশোধের দায় এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর সঙ্গে পাঁচ বৃহৎ প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষে বর্ধিত ঋণ দায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যকে আরো চাপে ফেলবে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি এরই মধ্যে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। রেমিট্যান্স ও রফতানিও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না। এর মধ্যেই ঋণ পরিশোধের দায় ও চাপ এভাবে বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো রিজার্ভ সংকট আরো ঘনীভূত হওয়া। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৩৯০ কোটি বা ২৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) বাংলাদেশের গ্রস রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও কম। 

গ্রেস পিরিয়ড হলো ঋণ চুক্তি সইয়ের সময় নির্ধারিত সময়সীমা, যা পার হওয়ার পর ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ শুরু করতে হয়। 

 অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত এক-দেড় দশকে যেসব মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেগুলোর গ্রেস পিরিয়ড এখন শেষ হচ্ছে বা হওয়ার পথে। ফলে সামনের দিনগুলোয় দেশের ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে। 

এ অবস্থায় এখনই বড় প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা থেকে সরে না এলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ভারসাম্য আরো চাপে পড়বে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোরও কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশে অনেক অপ্রয়োজনীয় বা স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে রূপপুর, পদ্মারেল, কক্সবাজার রেললাইন ও ঢাকা বিমানবন্দর এলাকার বিআরটি প্রকল্প অন্যতম। এসবের জন্য আগামীতে ঋণের কিস্তি পরিশোধের দায় আরো বাড়বে। এখনই যদি বড় প্রকল্প গ্রহণ বন্ধ করা না হয়, তাহলে অর্থনীতির বিপদ আরো বাড়বে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৬ সালের ৩ মে। অনুমোদনের সময় এর ব্যয় প্রাক্কলন করা ছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। 

বর্তমানে এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। 

চীনের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পটি নির্মাণ করছে ঐ দেশেরই এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ৩০ জুন। এতে অর্থায়নে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হয় ২০১৮ সালে। 

ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১৯ সালে। ১ বিলিয়ন ডলারের এ ঋণ চুক্তির গ্রেস পিরিয়ড আগামী মাসেই শেষ হচ্ছে। এ প্রকল্পে সুদহার ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ যুক্ত হবে আরো দশমিক ২৫ শতাংশ।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণে চুক্তি সম্পন্ন হয় ২০১৬ সালে। প্রকল্পের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে লাইবরের (লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফারড রেট বা লন্ডন আন্তঃব্যাংক সুদহার) সঙ্গে অতিরিক্ত ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রথম ইউনিটের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ হয়েছে ৭০ শতাংশ। এ প্রকল্পের গ্রেড পিরিয়ড শেষ হবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আরেকটি প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ প্রায় শেষ করে এনেছে বাংলাদেশ।

রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিপরীতে ঋণ ও দায়ের চাপ বাড়ছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্য ধরে রাখতে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কতটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে সংশয়ে আছেন অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা। 

অর্থ বিভাগের সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ঋণ পরিশোধ ও রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য সরকার অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এটা কতটা কাজে দেবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ ও রফতানিও প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না। তাই রেমিট্যান্স ও বহুজাতিক দাতাদের ঋণই এখন প্রধান ভরসা। তবে এসবের মাধ্যমে কতটা ভারসাম্য ধরে রাখা সম্ভব হবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি বা পিইডিপি-৪ প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লাখ ৬৫ হাজার ১৭৪ জন শিক্ষক নিয়োগ ও পদায়ন করা হচ্ছে। এতে গুরুত্ব পাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৮ হাজার ২৯১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আগামী বছরের এডিপিতেও ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে প্রকল্পটিতে। বিশ্বব্যাংক ও অন্য সহযোগীদের সমন্বয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৪৪৭ মিলিয়ন (৪৪ কোটি ৭০ লাখ) ডলার ঋণ নেয়ার বিষয়ে চুক্তি হয় ২০১৮ সালে। এক্ষেত্রে ঋণের সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর সঙ্গে চার্জ হিসেবে যুক্ত হবে আরো দশমিক ৫ শতাংশ। ছয় বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হচ্ছে চলতি মাসেই। ঋণ পরিশোধ শুরু হবে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে। তবে প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি।

ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি ২০১৭ সালে অনুমোদন দেয় সরকার। শুরুতে এর মেয়াদ ছিল ২০২২ সাল পর্যন্ত। পরে আরো চার বছর সময় বাড়ানো হয়। ২০২১ সালে প্রকল্পটির জন্য চীনের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। ১ দশমিক ১ বিলিয়ন (১১০ কোটি) ডলারের ঋণচুক্তির গ্রেস পিরিয়ড শেষ হবে দুই বছরের মধ্যে। তখন থেকেই ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। প্রকল্পে সুদহার ২ শতাংশ। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ ধরা হয়েছে দশমিক ২৫ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি)। 

ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলে পরে প্রয়োজনের সময় আরো ঋণ নিতে গেলেও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী। 

তিনি বলেন, বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের কোনো বিকল্প নেই এখন। এজন্য রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোয় মনোযোগ দিতে হবে। এ দুটিই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। রফতানিতে পোশাকের বাইরে চামড়া, ওষুধ ও কৃষিপণ্যের মাধ্যমে বহুমুখীকরণ করতে হবে। নতুন বাজার খুঁজতে হবে। বেশি মূল্যের পণ্য রফতানি করতে হবে। 

 ‘এখনো অনেক রেমিট্যান্স দেশে আসছে অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে। এসব রেমিট্যান্স বৈধ পথে আনার চেষ্টা করতে হবে। আর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে হবে, যেন বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে।’

যদিও সরকারের সাবেক ও বর্তমান নীতিনির্ধারকদের দাবি ঋণ পরিশোধের চাপ থাকলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, অবশ্যই ঋণ পরিশোধের চাপ আছে। তবে রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় কমছে। রিজার্ভের পতনও ধীর হয়ে এসেছে। এটা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। সুতরাং ঋণ পরিশোধের দায় বাড়লেও তা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না। আর আমরা বৈদেশিক সহায়তাও পাচ্ছি। অনেক লোকজন বিদেশে যাচ্ছে। তাই খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।