অর্থসংকটে উচ্চাভিলাষী বাজেট থেকে সরে আসছে সরকার

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। বাজেটে আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে ২ লাখ ৫১ হাজার টাকার বিশাল ব্যবধান থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই ঘাটতি দেশের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট ঘোষণার শেষ মুহূর্তে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছরে আর্থিক ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেট-সহায়তা ক্রেডিট হিসেবে জাপানের কাছ থেকে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে গৃহীত আইএমএফ-এর ঋণ ছাড়াও সরকার ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেট সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি ঋণদাতা এএফডি এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) সাথে যোগাযোগ করেছে।

বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন অংশীদার জাপান এখনও আর্থিক-সহায়তা নিশ্চিতকরণের জন্য সরকারের অনুরোধের জবাব দেয়নি।

এই পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের অনিশ্চয়তা ও আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে আগামী র্অথবছরের জন্য একটি উচ্চাভিলাষী বাজটে থেকে সরে এসেছে সরকার। বাজেট প্রণয়নের প্রথম দিকে মনে করা হয়েছিল আগামী অর্থ বছরে জন্য একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট আসছে।

বিদেশী অর্থে নির্মিত বড় বড় মেগা প্রজেক্ট- পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেল, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ জন্য আগামী অর্থ বছরে  প্রাক্কলন বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের প্রাক্কলন থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ  বাড়ানো হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার জোগান দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে, যা চলতি অর্থ বছরের লক্ষ্যমাত্রার (৫ লাখ কোটি টাকা) চেয়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। এ হিসাবে মোট বাজেটের ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যোগান দেওয়া গেলেও ঘাটতি বাকি ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশর যোগান দিতে হবে দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আদায়কৃত রাজস্ব ও ব্যবসা খাত থেকে এতো বড় অংকের রাজস্ব আদায় করা খুবই দূরূহ হয়ে পড়বে। রাজস্ব আদারের হার কম হওয়ার জন্য দেশের ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত এখন ৭ শতাংশের ওপরে উঠতে পারেনি। আইএমএফের বর্ধিত ঋণ সহায়তার আলোকে রাজস্ব আদায় জিডিপির ০ দশমিক ০৫ শতাংশ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের রাজস্ব ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে।

কেয়ারটেকার সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে অর্থনীতিকে সঠিক পথে নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হেব। আর আন্তর্জাতিক বৈরী অবস্থায় কোনোভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভাল হবে না। এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্র কমানো উচিৎ।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ হাতে টাকা নাই, কর দেবে কীভাবে। উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়াতে পারলে রাজস্ব আয় বাড়তে পারে।

মির্জা আজিজুল আরো বলেন, এতো বৈরী অর্থনৈতিক পরিবেশে কীভাবে বাজেটে মোট জিডিপির পরিমাণ এতো বেশি প্রাক্কলন করা হলো তা আমি বুঝতে পারলাম না।

বাজটের ঘাটতি ধরা হচ্ছে, ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা; যা জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি র্অথবছরে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমকি ২ শতাংশ। ফলে এবারের বাজেটে আগের বছরের তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ কমে যাচ্ছে প্রায় ৬ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

অর্থ বিভাগের বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, আগামী অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি আকার ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় অস্বাভাবিকভাবে ৫ লাখ ৯০ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা বা শতকরা হারে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

ঘাটতি পূরণে চলতি ২০২৩-২০২৪ র্অথবছরে বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলে আগামী বাজেটে তা আরও বাড়িয়ে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এখানে অনুদান বাবদ ধরা হচ্ছে, ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজটে হিসাব করা হয়েছিল তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

সেই হিসাবে আগামী বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে যাচ্ছে ৮ দশমিক ১১ শতাংশ এবং তা অংকের হিসাবে ১০ হাজার ৩১০ কোটি টাকা।
তবে আগামী র্অথবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে সরকাররে খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বাজটে সংশ্লিষ্টরা।

চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ধরা হলেও আগামী বাজেটে তা ধরা হয়েছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে এ খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। অংকের হিসেবে এ সংখ্যাটা দাঁড়াছে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

এ পরিমাণ ঋণ পরিশোধে পর আসন্ন বাজেটে বিদেশি নেট ঋণ পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের নেট ঋণ এক লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার চেয়েও সাড়ে ৭ শতাংশ কম।

ঘাটতি পূরণে এবারের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরের চেয়ে থেকে ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। শতকরা হারে বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অংকের হিসাবে বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এছাড়া আগামী বাজেটে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ৭২ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা ধরা হয়েছে , যা চলতি অর্থ বছর ছিল ৯৫ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় পত্র থেকে ঋণ ধরা হয়েছে, ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা যা চলতি অর্থ বছর ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী জাপানকে অন্তত ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন মূল্যের বাজেট সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ করেছি। এটি আমাদের অর্থনীতিকে একটি সহায়তা দেবে।

সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ঋণই এই ঘাটতি অর্থায়নের প্রধান উৎস, যার পরিমাণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণসহ ১ দশমিক ৫৫ ট্রিলিয়ন টাকা। এবং দুই প্রান্তপূরণ করতে দেশের বাইরে থেকে মোট ১ দশমিক ২৭ ট্রিলিয়ন টাকার তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকার তার ঘাটতি বাজেট পূরণ করার জন্য ‘বাজেটের তহবিল খুঁজতে আপ্রাণ চেষ্টা’ করে যাচ্ছে। তাতে আমাদের সমর্থন রয়েছে। তারা একমত যে কিছু অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক ধাক্কায় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

পিআরআই’এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইস মনসুর বলেন, দেশের ডলার ঘাটতি মেটানো জন্য বৈদেশিক সহায়তা খুবই প্রয়োজন। বাজেট বাস্তাবায়ন করতে হলে অবশ্যই বৈদেশিক তহবিলের খোঁজ করতে হবে। তাই দেশের সরকারী কর্মকর্তাদের বৈদেশিক সংস্থার সঙ্গে আলাপ আলোচনা জারি রাখতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার জন্য সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। এ অর্থনৈতিক অবস্থায় বাংলাদেশকে কেউ ঋণ দিতে চাইবে না।