লোকসান হলেও ইতালিতে জনতা ব্যাংক চালু রাখতে চায় বাংলাদেশ

বিদেশে ভাবমূর্তি ধরে রাখতে ইতালির জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি (জেইসি) বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মীনাক্ষী বর্মন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, জেইসি তার কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। 

গত ২৯ মে তারিখের চিঠিটি জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) কাছে পাঠানো হয়।

যদিও ক্রমাগত লোকসান ও অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালে জনতা ব্যাংক পিএলসি’র সহযোগী প্রতিষ্ঠান জেইসি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। পরে তা আবার চালু রাখার চিঠি জারি হলো। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ( আইএমএফ) ঋণের আওয়াত থাকা বাংলাদেশকে পরামর্শ হিসাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠান বন্ধের পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান মূল্যবান সরকারি সম্পদ নষ্ট করে। সরকারি আয়ের অসঙ্গতি তৈরি করে দেশের প্রবৃদ্ধিকে বাধা গ্রস্ত করে। সর্বশেষ চলতি বছরের বাজেটে বলা হয়েছে, দেশে সরকারি মালিকানাধীন ২৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে। লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের (বিএসইসি) অধীন চারটি, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫টি এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) অধীন নয়টি কোম্পানি রয়েছে।

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, জেইসির মধ্যে অনিয়ম এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা উভয়ই রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিরও অভাব রয়েছে। তাই প্রাথমিক পদক্ষেপ হওয়া উচিত কারণগুলো চিহ্নিত করা। ক্ষতি এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।

তিনি আরো বলেন, জেইসি যদি লোকসান অব্যাহত রাখে তবে এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

অন্যদিকে অথনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, লোকসান হলেও ইতালি আওয়ামী লীগের গুটিকয়েক নেতার জন্য এটা টিকিয়ে রাখতে চায় সরকার। সরকারি লোকসানি প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে আইএমএফএর ঋণের শর্তের বরখেলাপ হচ্ছে। এ বিষয়ে আইএমএফ নিরব কেন? 

চিঠিতে বলা হয়েছে, জেইসি, যা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সরকারি মূখপাত্র এবং পরিষেবা প্রদানকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, তা বন্ধ হলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। তাই জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানির অবসানে সরকার দ্বিমত প্রকাশ করেছে।

ইতালিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের মতামত অনুযায়ী, জেইসি, ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত। রোম এবং মিলানের দুটি শাখার মাধ্যমে ইতালি থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠায়। বর্তমানে ইতালির বেশ কয়েকটি প্রাইভেট এক্সচেঞ্জ কোম্পানি এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে এবং জেইসির চেয়ে বাংলাদেশে বেশি রেমিট্যান্স পাঠায়। 

দূতাবাস জানায়, একটি এজেন্ট নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা এবং কোম্পানিকে লাভজনক করতে ‘সময়-সীমাবদ্ধ কৌশলগত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা’ ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বানকা ডি'ইতালিয়াতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জমা দেওয়া হয়েছিল। সেটি অনুমোদিত হলে জিইসি, ইতালির গুরুত্বপূর্ণ শহর বা অবস্থানে এজেন্ট নিয়োগ করতে পারবে এবং সেসব এলাকায় বাংলাদেশি প্রবাসীদের সেবা দিতে পারবে। এটি জেইসিকে ধীরে ধীরে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সুযোগ দেবে।

তাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, জিইসি একমাত্র বাংলাদেশি টাকায় সরকারি পেমেন্টের আর্থিক প্রতিষ্ঠান। 

ইতালিতে বাংলাদেশ দূতাবাস আরও পর্যালোচনা করে যে, জেইসি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র স্বীকৃত পেমেন্ট ইনস্টিটিউট। অতএব, জিইসি বব্ধ হয়ে গেলে সরকারের ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদী বা আশু প্রয়োজনে ইইউ অঞ্চলে কোনো সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক্সচেঞ্জ হাউস বা পেমেন্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে। উপরন্তু, জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানির উপস্থিতি ইতালিতে ব্যক্তিগত রেমিট্যান্স পরিষেবা প্রদানকারীকে বাধ্য করে রেমিটরদের একটি যুক্তিসঙ্গত বিনিময় হার দিতে।

তারা বলে, জিইসিকে লিকুইউডেশন করা হলে, এই বিনিময় হার হ্রাস পাবে, যার ফলে প্রাইভেট কোম্পানিগুলির আধিপত্য একচেটিয়া বাজারের দিকে পরিচালিত হবে। ফলস্বরূপ, প্রবাসী বাংলাদেশিরা বেশি খরচে বা অনিয়মিত বা অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠাবে, তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক জেইসির লোকসান মেটাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ২,৫,৯৫,৫০০ ইউরো (প্রায় ২৬ দশমিক ২৪ কোটি টাকা) অনুমোদন করেছে। যা দিতে সরকার সম্মত হয়েছিল। এই আর্থিক সহায়তাকে ‘পুনঃপূরণ’ বলা হয়।

অভ্যন্তরীণ সূত্র অনুসারে, জনতা ব্যাংক পিএলসি ২০০২ সালে রোম এবং ইতালির মিলানে জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানির দুটি শাখা খোলে, যা ২০০৮ সাল পর্যন্ত লাভজনক ছিল। কিন্তু ২০০৯ থেকে লোকসান শুরু করে।

২০১৮ সালে জেইসি ইতালির লোকসানের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ইউরো। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক জনতা ব্যাংকের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে এবং জেইসি ইতালির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়। এই বন্ধের আদেশ শেষ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরামর্শে জেইসিকে লাভজনক করতে দুই বছরের পরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়।

জনতা ব্যাংক পিএলসি যুক্তরাজ্যেও ছয়টি শাখা খুলেছে। এর মধ্যে চারটি শাখা লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ওল্ডহাম শাখাটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালে শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক ইকবাল আহমেদের বিরুদ্ধে ২৫০,০০০ মার্কিন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। 

ক্রমাগত লোকসানের মুখে, লুটেন, ক্যামডেন এবং ব্র্যাডফোর্ড শাখাগুলি ২০২০ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে শুধু বার্মিংহাম এবং লন্ডনের প্রধান শাখাগুলি চালু রয়েছে। তবে এ দুই শাখাও লড়াই করছে। এগুলো চালু রাখতে সরকার সোনালী ব্যাংক পিএলসিকে ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছে।