‘মামনি, বাবার নামের আগে লেট লিখতে হয় কেন?’

২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকার খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনি। তার বিধবা স্ত্রী মুনিয়া পারভীন। জনি-মুনিয়ার নয় বছর বয়সী পুত্র সন্তান রাজধানীর একটি বেসরকারী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। জনি খুন হওয়ার সময় মুনিয়া ৭ মাসের গর্ভবতী ছিলেন। জন্মের পর তাদের এই শিশু সন্তান বাবা জনির আদর স্নেহ পায়নি। তার জানা হয়নি, বাবার বুকে কতটা ওম পাওয়া যায়। দ্য মিরর এশিয়া নিহত জনির স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য মিরর এশিয়ার ঢাকা প্রতিনিধি।  

দ্য মিরর এশিয়া : কেমন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে জীবন কাটছে?

মুনিয়া পারভীন: জনি হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আমি আমার বাবা-মায়ের পরিবারের সাথে থাকছি। একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করছি। বাচ্চার বয়স ৯ বছর হয়েছে। মালিবাগের একটি বেসরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। বাচ্চার স্কুল বন্ধ থাকলে সময় সুযোগ মতো জনির বাবা মায়ের সাথে দেখা করি। মাসে এক বার দুই বার যাওয়ার চেষ্টা করি। নাদিবুজ্জামান নহর জন্মের পর তো আর বাবার স্নেহ ভালবাসা পায়নি। ওর কাছে আমিই বাবা, আমিই মা। আমিই সব। আগে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতো, বাবা কোথায়? আমি বলতাম; বাবা আল্লাহর কাছে চলে গেছে। আল্লাহ বাবাকে বেশি ভালোবাসে; তাই বাবা আল্লাহর কাছে চলে গেছে। নহর বলতো, মামনি, তাহলে কী আল্লাহ আমাদের ভালোবাসে না? আমাদেরকে কেন নিল না? আমি জবাব দিতাম, আমাদেরকে একটু কম ভালোবাসে। বাবাকে বেশি ভালোবাসে। আল্লাহ যাকে বেশি ভালোবাসে, আল্লাহ তাকে তাঁর কাছে নিয়ে যায়। এখন আর বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে না নহর। অনেকটা সয়ে গেছে। এখনো বলে মামনি আমার বাবার নামের আগে কেন লেট লেখা- আমি বলেছি, যাদের বাবা মৃত তাদের নামের আগে লেট লিখতে হয়।

দ্য মিরর এশিয়া : ওই দিন কী হয়েছিল?

মুনিয়া পারভীন: : জনিকে হত্যা করা হয়েছে জানুয়ারির ১৯ তারিখে। এর দু’তিন দিন আগে থেকেই ওর এক কাজিনের বাসায় ছিল। ওই সময় অনেককেই পুলিশ আটক করেছিল। জনির ছোট ভাই মনিরুজ্জামান হীরাকে পুলিশ বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেল। ১৯ তারিখ সকালে নাজিমুদ্দিন রোডের জেলখানায় হীরাসহ খিলগাঁও থানায় আটক বেশ কয়েক জনের সাথে দেখা করতে যায়। আমার আবার ওই দিন ডাক্তারের কাছে চেকআপের ডেট নির্ধারিত ছিল। আমি তখন ৭ মাসের গর্ববতী। যাওয়ার সময় আমি ফোনে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু জনি বলেছিল, সমস্যা নেই। বেশি সময় লাগবে না। ওদের দেখেই চলে আসবো। আমাকে বলেছিল, ‘তুমি গোসল করে তৈরি থেকো’। দুপুর ১টা দেড়টার দিকে ফোন দিলাম। ফোন কেটে দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে, জনি আমার ফোন ধরে না। কেটে দিয়ে কলব্যাক করে। আমি মনে করেছিলাম, হয়তো কলব্যাক করবে। কিছুক্ষণ পর আবারো ফোন দিলাম। আবারো কেটে দিচ্ছে। বার বার কেটে দিচ্ছে। তখন বুঝতে পারলাম; কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। টেক্সট ম্যসেজ পাঠালাম, ‘আরজেন্ট কল করো’। কোনো রিপ্লাই নেই। তখন ধরেই নিলাম, আসলেই কোনো না কোনো সমস্যা হয়েছে। তার পর থেকে ফোন বন্ধ। তিনটা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষার পর আমি বেরিয়ে পড়লাম। জেলগেটে গেলাম। আশপাশের সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম। এখান থেকে কাউকে আটক করা হয়েছে কি না। কেউ কিছু বলতে পারলো না। সন্ধ্যার দিকে কবি নজরুল কলেজ ছাত্রদলের এক জন ফোন দিয়ে আমাকে বললো, সাদা পোশাক পরা পুলিশের একটি টিম জনিকে টেনে হিঁচড়ে জেলগেট থেকে গাড়িতে তুলেছে। তখন নিশ্চিত হলাম, ডিবি ওকে তুলে নিয়ে গেছে। ওর সাথে খিলগাঁও থানার মঈন নামে আরো এক জনকে ধরেছিল। আমি কখনো মঈনকে দেখিনি।

দ্য মিরর এশিয়া : এরপর কোথাও যোগাযোগ করেছিলেন?

মুনিয়া পারভীন: : হ্যাঁ। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। থানায় গেলাম। পরদিন ভোর বেলা (২০ তারিখ) মঈনের ছোট ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললো, আপু ওদেরতো খবর পাওয়া গেছে। ডিবি পুলিশ ধরেছিল। অনেক মারধর করেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেছে। আমাকে বললো, তুমি তো (মুনিয়া) অসুস্থ্; তোমার আসার দরকার নেই। জনির বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সবাইকে পাঠিয়ে দাও। তুমি বিকেল বেলা এসে দেখে যেও। আমি বললাম, আমি আসলে সমস্যা কী? বললো, না এই শরীর নিয়ে আসার দরকার নেই। আমি বললাম, আমার স্বামী, আমার আসার দরকার নেই কেন? বলে আমিও বের হলাম। সবাই জেনে গেছে। আমাকে জানানো হয়নি। আমি ঢাকা মেডিকেলে গেলাম। সব জায়গায় খোজাখুঁজি করলাম। একজন এসে বললো, মর্গে। আমার মাথায় তখনো আসেনি, আসলে মর্গে কেন রাখা হয়েছে।

দ্য মিরর এশিয়া : মর্গে কী দেখলেন?

মুনিয়া পারভীন:  ১৬ টা গুলি বুকে। একটা গুলি ঘাড়ে। আর একটা গুলি বাম হাতের তালুতে। মোট ১৮টি গুলি বিদ্ধ শরীরে।

দ্য মিরর এশিয়া : কী মনে হয়েছে?

মুনিয়া পারভীন: প্রশাসন তো অবশ্যই। এগুলো তো স্টেট মার্ডার। আমি তখনো গণমাধ্যমে বলেছিলাম। এটা ক্রসফায়ার না। পরিষ্কার মার্ডার। আমার স্বামী শুধু রাজনীতি করতো। সে তো কোনো সন্ত্রাসী না, ধর্ষক না। জনিকে এলাকার সব দলের লোকজনই পছন্দ করতো। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার নামে মামলা ছিল। যারা রাজনীতি করে সবার নামেই তো মামলা আছে। রাজনীতি করা কী অপরাধ?

দ্য মিরর এশিয়া : মামলা করেছিলেন?

মুনিয়া পারভীন: মামলা করবো কীভাবে? আমাকে তো মেডিকেল থেকে কোনো কাগজই দেওয়া হয়নি। এখনো দেওয়া হয়নি। জনির বাবা ঘটনার আট বছর পরে আদালতে একটি মামলার আবেদন করেছিল। কিন্তু এখন কী অবস্থায় আছে সেই মামলা, তা জানি না। উল্টো ঘটনার পর থেকেই আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। আমি কেন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাথে কথা বলছি, কেন গণমাধ্যমে কথা বলি। এসব নিয়ে এখনো অফিসে যাওয়ার পথে রিক্সা থামিয়ে রাস্তায় আমাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এমনকি আমার সহকর্মীদের পর্যন্ত হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

দ্য মিরর এশিয়া : কারা হুমকি দিয়েছে?

মুনিয়া পারভীন: আমি চিনি না। সাদা পোশাকের মানুষ। পুলিশের জ্যাকেট পরা মানুষরা এমন হুমকি দিচ্ছে। তাদের আসল পরিচয় আমি কখনো খুঁজতে যাইনি। জানিও না।

দ্য মিরর এশিয়া : কী মনে হয়, আপনার সন্তান তার বাবার হত্যার বিচার পাবে?

মুনিয়া পারভীন: আমার প্রশ্ন হলো, কী কারণে জনিকে মারা হলো? জনি কোন ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল? ছাত্রদলের খিলগাঁও থানার সাধারণ সম্পাদক ছিল। ওর কী-ই বা ক্ষমতা ছিল। একজন মানুষকে নির্মম ভাবে ১৮টি গুলি করে মারার কারণটা কী?

দ্য মিরর এশিয়া : আপনি কি পুলিশকে এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন?

মুনিয়া পারভীন: হ্যাঁ। খিলগাঁও থানা থেকে পরের দিন বলা হয়েছিল, জনি না কি পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করেছিল। তখন পুলিশরা বাঁচার জন্য জনিকে গুলি করেছে। এটাতে সাজানো কথা। সাধারণ মানুষ পুলিশকে মারার জন্য গুলি করে- এটা কেউ বিশ্বাস করবে?

দ্য মিরর এশিয়া : এ ঘটনায় কারা জড়িত ছিল?

মুনিয়া পারভীন: খিলগাঁও থানার এসআই ছিলো তখন। মুনিরুজ্জামান নাম। আমি এ বিষয়টি নিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাটি করেছি। এখন বন্ধ করে দিয়েছি। এখন তো দেশে থাকাই টাফ। বেঁচে থাকাই টাফ। এ ঘটনার মূল হর্তাকর্তা ছিল পুলিশের কর্মকর্তা কৃষ্ণপদ রায়, রবিউল ছিল- সে তো হলি আর্টিসান ঘটনায় মারাই গেল। এসআই মনির শেষ গুলিটা ঘাড়ে করেছে। তখনও জনি মারা যায়নি। তখন গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে এসআই মনির ঘাড়ের ওপর শেষ গুলিটা করেছে।

দ্য মিরর এশিয়া : আপনি তো দেখেননি,  এগুলো জানলেন কীভাবে?

মুনিয়া পারভীন: জনিকে মারা হয়েছে খিলগাঁও জোড় পুকুর মাঠে। রাত ১২টার পরে ওকে মারা হয়েছে। আশে পাশের দু’একজন দোকানদার যারা ছিল, এলাকার রাস্তাঘাটে ঘোরে যারা; আশপাশ থেকে দেখেছে। এদের কাছে থেকেই এসব বর্ণনা পেয়েছি আমি।

দ্য মিরর এশিয়া : আপনি কি ভয়ে আছেন?

মুনিয়া পারভীন: আমাকে এখনো নানা ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে। আমার আপন ছোট ভাই এপিলিপসি (খিচুনি) রোগী। গত কোরাবানীর ঈদে ঈশ্বরদী আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। ট্রেন থেকে নামার পরপরই স্থানীয় একটি মার্ডারের ঘটনায় ওকে থানায় নিয়ে আটকে রাখা হয়। শুধু জনির শ্যালক বলে চার দিন থানায় রেখে নির্মমভাবে পেটানো হয় আমার ছোট ভাইটাকে। পরে বহু টাকা-পয়সা খরচ করে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পায়। চার্জশিটে উল্লেখ করেছে, আমার সেই ছোট ভাই নাকি চায়না থেকে আগ্নেয়াস্ত্র এসে জনিকে সরবরাহ করতো। এসব অবান্তর ঘটনা দিয়ে হয়রারি করা হচ্ছে। এখানে এই দেশে আর থাকার মতো কোনো পরিবেশ নেই।

দ্য মিরর এশিয়া : কী মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়েই চলে যেতে হবে?

মুনিয়া পারভীন: দেশটা নষ্ট হয়ে গেছে, পচে গেছে। আমার সন্তানের জীবন নিয়ে আমি শঙ্কিত। এখান থেকে যেতে পারলেই আমি বেঁচে যাব। যে দেশে সামান্য ফেসবুকে একটা স্ট্যটাস দিলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আওয়ামী লীগের লোকেরা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বউকে তুলে নিয়ে বেচে দিতে পারে; যেখানে আমি সাধারণ জনগণ হয়ে একটা কথা বলতে পারবো না। সেই দেশে থেকে কী করবো। এটাকে দেশ বলে? আমি যদি একবার এই দেশ ছাড়তে পারি, আমি আর এই দেশে জীবনে পা রাখবো না।

দ্য মিরর এশিয়া : আপনি কি স্বামী হত্যার বিচার চান?

মুনিয়া পারভীন: কার কাছে চাইবো বিচার।

দ্য মিরর এশিয়া : আপনার কি মনে হয়, কেন এসব হত্যাকাণ্ড?

মুনিয়া পারভীন: শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই সবগুলো হত্যাকাণ্ড। যাদেরকে মারা হয়েছে, তাদের কোনো অপরাধ নেই।

দ্য মিরর এশিয়া : দলের পক্ষ থেকে কি খোঁজ-খবর নেওয়া হয়?

মুনিয়া পারভীন: হ্যাঁ। মির্জা আব্বাস ভাইসহ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমার সন্তান, আমার এবং জনির বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নেন। পাশে থাকেন। আমিও সমস্যা হলো বা কোনো প্রয়োজন পড়লে, তাদের সাথে যোগাযোগ করি। তাদেরকে পাশে পাই।

দ্য মিরর এশিয়া : আপানাকে ধন্যবাদ।

মুনিয়া পারভীন: দ্য মিরর এশিয়াকেও ধন্যবাদ।