১৬ বছরে সরকার কোন পণ্যের দাম কমাতে পারল না

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

মূল্যস্ফীতি এবং দেশে বিনিয়োগ না হওয়ায় অনেক মানুষের চাকরি চলে গেছে। কারও বেতন কমেছে, কেউ আবার নতুন করে শুরু করার সংগ্রাম করছেন। দেশের ব্যাংকিং খাতের খারাপ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে গেছে, তখনই হিসাব পাল্টে দিচ্ছে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি। বর্তমানে কোরবানি ঈদের আগে দ্রব্য মূল্য পরিস্থিতির এসব দিক নিয়ে দ্য মিরর এশিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

প্রশ্ন: ভারতীয় পণ্য মূল্য দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা দরকার কি?

গোলাম রহমান: অবশ্যই দরকার। সরকারকে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। এখন দেখছেন ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কীভাবে দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজ ঢাকায় প্রতি কেজি ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

প্রশ্ন: যে কোন উৎসবের আগে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে থাকে। এর প্রভাব থেকে মানুষকে বাঁচাতে সরকার কি করতে পারে?

গোলাম রহমান:  ১৬ বছর ধরে এ সরকার নিত্যপণ্যের দাম কমানোর নানা ধরনের  উদ্যোগ নিয়েছে । অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।  আর এখন ৯ শতাংশ   মূল্যস্ফীতির জন্য সাধারণ মানুষের হাতে এখন কোনো টাকা পয়সা নেই।  আর, বিশেষ করে যাদের ‘অবৈধ’ আয়ের পথ নেই, তারা খুবই কষ্টে আছে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ওই কাতারে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। বিশেষ করে সীমিত আয়ের বেসরকারি চাকরিজীবীরা আরও বেশি সংকটে আছেন। টিসিবি থেকে রাস্তার ওপর যে পণ্য বিক্রি করছে, তাতে মানুষের লাইন দেখলে বিষয়টি বোঝা যায়। একসময় নিম্ন আয়ের মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য কিনত। কিন্তু এখন মধ্যবিত্তরাও লোকলজ্জা ভুলে সে লাইনে দাঁড়াচ্ছে।

প্রশ্ন: নিত্যপণ্যের দাম কমানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনি কি হতাশ?

গোলাম রহমান: অবশ্যই হতাশ। ১৬ বছরে সরকার কোন পণ্যের দাম কমাতে পারল না। বাজারের নিত্যপণ্যে সিন্ডিকেট কেউ ভাঙতে পারল না। আমি এ বিষয়টি নিয়ে আশ্চর্য হয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হবে। তবে সব দোষ আমি সরকারকে দিতে চাই না। ভোক্তারও দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব তো পালন করতে দেখি না। নিত্য পণ্য সংকটের সময়ে জনসাধারণ বেশি পরিমাণে নিত্যপণ্য কিনে থাকে। এটা কিন্তু সংকটকে আরো বাড়িয়ে দেয়। অবশ্যই সরকার জনসাধারণকে এ বিষয়টি বোঝাতে পারল না। সরকারের এখানে দায় সারা একটা ভূমিকা আছে। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আগে মানুষ যে পরিমাণ খাওয়াদাওয়া করত, ব্যয় কমাতে তা অনেকটা কমিয়ে এনেছে। আগে সংসারে হয়তো তেল খরচ করত ৮ লিটার, এখন করছে ৪ থেকে ৫ লিটার। মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। এর মধ্যে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রশ্ন: জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী?

গোলাম রহমান: এখন বড় বড় ব্যবসায়ী,  কর্পোরেট কোম্পানির মালিকরা রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। তারা সব সময় অধিক মুনাফা করার পক্ষে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের বাজার পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা বা মূল্য নির্ধারণের যে পদ্ধতি, তা সেভাবে কাজ করছে না। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে মাঝেমধ্যে দ্রব্য মূল্যর ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু এর মূলে যারা আছে, তাদের ব্যাপারে কোনো সুপারিশ করা হয় না বা করতে হয়তো ভয় পান সরকারি কর্মকর্তারা। অন্যদিকে কাঁচামালের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাইকারি বাজারে সবজির দাম অনেক কম। সেই তুলনায় খুচরা বাজারে দাম কয়েক গুণ বেশি। ব্যবসায়ীদের বর্তমান প্রবণতা হলো, যেভাবেই হোক বেশি মুনাফা করতে হবে। এ ছাড়া ওই ব্যবসায়ীরা বুঝে গেছেন, দাম বাড়ালেও এগুলো দেখার বা সুরাহা করার কোনো ব্যবস্থা নেই।

প্রশ্ন: কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশন অনেক মামলা করেছে। এ বড় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিতে পারল না সরকার?

গোলাম রহমান: সেই মামলা তো অনেক বছর ধরে চলছে । সেই সব বড় কোম্পানি, যেমন- বসুন্ধরা, এস আলম, তীর-এর মতো কোন কোম্পানির  বিরুদ্ধে সরকারকে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখলাম না।  এ সব কোম্পানি থেকে সরকার অনেক সুবিধা নিয়ে থাকে। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ জন্য সরকারের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা থাকতে হবে। সেটা কি সরকারের আছে?

প্রশ্ন: মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কী করা উচিত?

গোলাম রহমান: এ দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে অবশ্যই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন আনতে হবে। কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রে সেক্টর অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের সমিতি আছে। সরকার যদি নিয়মিত বসে, বাজার পর্যবেক্ষণ করে এবং নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তির আওতায় আনা যায়, তাহলেই দ্রব্য মূল্য কমতে পারে। কিন্তু এগুলো কে করবে, কে দায়িত্ব নেবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।