জিয়াউর রহমান ইনক্লুসিভ রাজনীতির ধারা গড়তে চেয়েছিলেন

ফরহাদ মজহার। ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত

কবি, ঔষধশাস্ত্রবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, সামাজিক ও মানবাধিকার কর্মী এবং পরিবেশবাদী ফরহাদ মজহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দি নিউ স্কুল ফর সোশাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। ‘চিন্তা’ নামক একটি পত্রিকার সম্পাদক তিনি। উবিনীগ গঠন করে নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো: প্রস্তাব, মোকাবিলা, এবাদতনামা, মার্কস পাঠের ভূমিকা, রাজকুমারী হাসিনা। দ্য মিরর এশিয়া'র সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

দ্য মিরর এশিয়া:  বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে বলুন

ফরহাদ মজহার: প্রথমত ‘রাজনীতি’ বললে যে একটা বিশেষ পরিসর আমরা বুঝি– অর্থাৎ জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করার পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যবস্থা– সেটা  কখনওই বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে বলা মানে একটা পোস্ট-কলোনিয়াল ও আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রান্তিক সমাজের বিরাজনীতিকরণের ইতিহাস নিয়ে বলা। অর্থাৎ নিউ-লিবারেল বা বাজারসর্বস্ব বিশ্বব্যবস্থায় কীভাবে বাংলাদেশকে রাজনীতি শূন্য করা হয়েছে সেই ইতিহাস বর্ণনা করা। বাংলাদেশে কোনো রাজনীতি নাই, জনগণকে রাজনীতি অর্থাৎ গণক্ষমতা অর্জনের লড়াই থেকে দূরে রেখে ভোটের লড়াই নামক বাজারি প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার তামাশাকে বলা হচ্ছে রাজনীতি। জনগণকে ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়া থেকে বিযুক্ত করে বা দূরে রেখে পুরা দেশকে পরাশক্তির অধীনস্থ রাখা এবং মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণির লুটতরাজ প্রকাশ্যে চালিয়ে যাবার দারুণ উদাহরণ বাংলাদেশ। এখানে রাজনীতি নাই। 

এর ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদের ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়নের কোনো সুযোগ দেননি। পাকিস্তানের সংবিধান বানাবার জন্য আমরা যাদের ভোট দিয়েছিলাম তিনি তাদের দিয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু করেছিলেন। যারা আইনী অর্থে ছিল ‘পাকিস্তানী’। তারা পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ‘লিগাল ফ্রেইমওয়ার্ক অর্ডারে’র অধীনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারাই স্বাধীন বাংলাদেশে সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সংবিধান আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এর কাফফারা আজ অবধি বাংলাদেশের জনগণকে দিতে হচ্ছে। এরপর যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারা সংবিধান কাঁটাছেড়া করেছে। 

দরকার ছিল নাগরিকদের পারস্পরিক সম্বন্ধ কী হবে– অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক সম্বন্ধ, ক্ষমতার রূপ বা রাষ্ট্রের ধরন কেমন হবে, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান কী করে আমরা গড়ে তুলব ইত্যাদি নিয়ে ভাবনা। দরকার ছিল শিক্ষাদীক্ষা, ধর্ম ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিবেশ ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেবার পরিবেশ তৈরি করা। অর্থাৎ রাজনীতিকে সবল ও শক্তিশালী করতে হলে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক পরিসর মজবুত করা। কিন্তু আমরা তো তা করিনি, করি না এবং রাজনৈতিক পরিসর না থাকলে রাজনীতি নামক কিছু থাকে না, সেটা কালো টাকাওয়ালাদের ভোট কেনার ব্যবসা হয়ে ওঠে এই সিম্পল সহজ সরল সত্যও বুঝি না। এমনকি রাজনীতির প্রয়োজনীয়তাও বুঝি না। তো, এই তো অবস্থা! 

দ্য মিরর এশিয়া: তাহলে কি আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নাই?

ফরহাদ মজহার: না, আমি তা বলব না। ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হলে প্রস্তুতি দরকার। আমি টের পাই তরুণদের মধ্যে একটা প্রস্তুতি চলছে। এখনকার ডান-বাম সকল কিসিমের রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংগঠনিক হিম্মত অর্জন করতে  হবে, তবে সবার আগে তাদের ইতিহাসের দিকে নজর ফেরাতে হবে, তীক্ষ্ণ করতে হবে। অতীত ও বর্তমানের ঘটনাঘটন পর্যালোচনা করতে হবে, বুঝতে হবে। কংক্রিট ইতিহাস বিচারের মধ্য দিয়ে আগামীর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

যেমন ধরুন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ নতুনভাবে গঠনের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামক চরম গণবিরোধী তত্ত্ব দিয়ে এরশাদকে সরিয়ে পুরানা কাটাছেঁড়া করা সংবিধানই জারি রাখা হোল, যার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে আজগুবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণার প্রবর্তন করা হোল। এক এগারোর পর শেখ হাসিনা এসে সংবিধানের খোলনলচে বদলে দিলেন। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবেই এখন একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট প্রতিষ্ঠান উৎখাত করে জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুনভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ না করলে বাংলাদেশ আদৌ টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। যেটা টিকে থাকবে এবং আরও শক্তিশালী হবে সেটা হোল মাফিয়া, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের স্বর্গরাজ্য। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের গণতন্ত্র কায়েম করে দেবে এই ধরনের দিবাস্বপ্ন।

দ্য মিরর এশিয়া: এটাই কি একমাত্র পথ? আর কী করা যায় বা করা যেত? 

ফরহাদ মজহার : ঠিক আছে, রাষ্ট্রকে নতুন করে বানানোর কথা না ভেবে নিদেনপক্ষে আমরা সংস্কার করবার চেষ্টা করতে পারতাম। যেমন, নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের হাতে সোপর্দ করা, শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন এবং শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা ইত্যাদি। অর্থাৎ একটা লিবারেল নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমরা হয়তো গড়ে তুলতে পারতাম। যা বাংলাদেশকে নতুন করে গঠন করবার অর্থাৎ বড় কাজের পদক্ষেপ তৈরির সহায়ক হোত। সেটা নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল- জাতীয় অবস্থা হোত অন্তত। কথা হোল, ভাতেও নাই নুনেও নাই এ দিয়ে তো হয় না। ন্যূনতম ব্যবস্থা ছাড়া কোনো লিবারেল রাজনৈতিক পরিসরও গড়ে উঠতে পারে না। বিশেষত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে জনগণের মতামত বা সিদ্ধান্ত আদায় এবং কার্যকর কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া কীভাবে দেশ চলতে পারে? তাই নির্বাচনী রাজনীতি অর্থহীন ও অন্তঃসারশূন্য। আমরা এগুতে পারছি না কেন? কারণ আমাদের মতো পোস্ট-কলোনিয়াল সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ খুবই শ্লথ বা নাই বললেই চলে, আমরা যারপরনাই পাশ্চাত্যমুখি এবং বাদামি সাহেব হওয়াই আমাদের সাধনা। এই সকল দেশে পরিবর্তন কঠিন। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দিকে তাকান। বুঝবেন। দেশ পরিচালনার ন্যূনতম লিবারেল ব্যবস্থা সম্পন্ন ভারতের দিকে তাকান। তাদের নিদেনপক্ষে নির্বাচন কমিশন আছে। ভারত কঠিন সময় পার করছে, কিন্তু রাজনৈতিক পরিসর টিকিয়ে রাখবার প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনী ব্যবস্থা এখনও কিছুটা টিকে আছে। বাংলাদেশে যে সম্ভাবনা ছিল শেখ হাসিনা তাও আমাদের করতে দিলেন না। বিরোধী দলকে ধ্বংস ও নির্মূল করা এবং একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট রাজত্ব কায়েম করাকেই তিনি তার রাজনৈতিক আদর্শ মেনে নিয়েছেন। ভয়ংকর। বিপরীতে বিএনপি ভাঙা রেকর্ডের মতো বলতে থাকল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাও, আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাই। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা কংক্রিট কী করবে তার কোনো চিন্তা নাই। জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতিবাদের বিপরীতে একটা ইনক্লুসিভ লিবারেল রাজনীতির পরিসর গড়তে চেয়েছিলেন। সেটা একটা সফল রূপ লাভের আগেই তাকে হত্যা করা হোল। খালেদা জিয়া চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান যেভাবে একদিকে র‍্যাডিকেল বামধারা এবং অপরদিকে ইসলামপন্থিদের নিয়ে একটা সমন্বিত কিম্বা ইনক্লুসিভ  রাজনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন – এমনকি শেখ হাসিনাকেও দেশে ফিরতে দিলেন – বিএনপি সেই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। গত পনেরো বছরব্যাপী জনগণ নির্বাচন না, একটা ইতিবাচক পরিবর্তন চাইছিল। নিদেনপক্ষে তারা আওয়ামী লীগের হাত থেকে নিষ্কৃতি চেয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার গুম, খুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যাসহ লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মীকে ঘর ছাড়া, এলাকা ছাড়া, দেশ ছাড়া করে দুঃসহ ও দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি করেছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে গিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা আরও জটিল হয়েছে। এই অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়া এখন আগের চেয়ে খুবই কঠিন। 

দ্য মিরর এশিয়া: কেন

ফরহাদ মজহার: কারণ বিদেশী পরাশক্তি এক এগারোর ‘মাইনাস টু’ প্রকল্প এবং বাংলাদেশের বিরাজনীতিকরণ সফলভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছে। সেটা এক এগারোর সময় তাদের মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়তো হয়নি, কিন্তু ভিন্নভাবে হয়েছে। খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে কার্যত অপসারণ করা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে অপসারিত করা হয়েছে। তার মানে শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট চরিত্র এবং খুনি শাসকের ভাবমূর্তি প্রকাশ এবং প্রতিষ্ঠিত করে তাকে রাজনৈতিকভাবে হত্যাই করা হোল। আওয়ামী রাজনীতির কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। পাশ্চাত্য পরাশক্তি ‘ব্যাটলিং বেগমস’-এর যে তত্ত্ব দিয়েছিল সেই অনুসারে দুই ব্যাটলিং বেগমের হাত থেকে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ তাদের নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে পেরেছে। কুক্ষিগত করেছে। তারা এখন আমাদের নিয়ে খেলবে। বাংলাদেশ এখন ষোল আনা একটি পরাধীন দেশ। বাংলাদেশের রাজনীতি কিম্বা রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের কোনোই নিয়ন্ত্রণ নাই। কারুরই নিয়ন্ত্রণ নাই। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোরও নাই। সেটা চলে গিয়েছে গুটিকয়েক মাফিয়া ও লুটেরা পরিবারের হাতে। এই ফাঁদ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মুক্ত হওয়া কিম্বা মুক্ত থাকা কঠিন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন করা এবং এক মাফিয়া শক্তির জায়গায় আরেক গ্রুপকে ক্ষমতায় বসানোকে যদি আমরা রাজনীতি মনে করি তাহলে এই গহ্বর থেকে বের হয়ে আসা কঠিন। রাজনীতি এখন বিনিয়োগ ও মুনাফার ক্ষেত্র মাত্র। 

দ্য মিরর এশিয়া: আমেরিকান স্যাংশন সম্পর্কে কী মনে করেন

ফরহাদ মজহার: আগাগোড়া হিপোক্রাসি মনে করি। গণতন্ত্র বলুন কিম্বা মানবাধিকার বলুন, তৃতীয় বিশ্বের জনগণের প্রধান দুশমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা। সেই দিক থেকে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার সংগ্রামে আমাদের থাকা উচিত এবং আঞ্চলিকভাবে আমাদের শত্রুমিত্র সঠিকভাবে চিহ্নিত করা ছাড়া আমরা কোনো ইতিবাচক রাজনৈতিক কৌশল গড়ে তুলতে পারব না। কিন্তু মার্কিন কিম্বা ইউরোপের জনগণ শত্রু নয়, কিম্বা সেদিক থেকে ভারতের জনগণও নয়। একালে স্থানীয় লড়াই বলে কোনো লড়াই নেই। সব লড়াই-সংগ্রামই বৈশ্বিক। একালে এই সহজ সাধারণ সত্য আমাদের মনে রাখতে হবে। আমরা একটা বিশ্বব্যবস্থার শিকার ফলে সবসময়ই বিশ্বব্যবস্থা এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। 

সেই ক্ষেত্রে মার্কিন স্যাংশনকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করতে জানা এবং ব্যবহার করতে পারার দরকার আছে। কিন্তু অনেকে মনে করেছেন ওয়াশিংটন ক্ষমতাসীনদের সরিয়ে বিরোধী দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে – এই চরম মূর্খতা এবং কূপমণ্ডূকতার কুফল বিরোধী দল ভোগ করছে। আরো ভোগ করতে হবে। আফসোস। খেয়াল করুন, আমরা ইসরায়েলের গণহত্যার বিপরীতে ফিলিস্তিনী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে কোনো ব্যাপক গণসমর্থন কিম্বা বিক্ষোভ গড়ে তুলতে পারলাম না। বিএনপি কিছুই করলো না। এটা অবিশ্বাস্যই বলতে পারেন। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষ শক্তির বিরোধিতা এবং ক্ষমতায় যাবার ক্ষেত্রে তারা একে বাধা গণ্য করেছে। মার্কিন পদলেহনের ফল দেখুন। 

দ্য মিরর এশিয়া: বাম রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

ফরহাদ মজহার: সামরিক সরকার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় বাংলাদেশে ‘বাম’ দলগুলো গণঅভ্যূত্থান ও নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠনের পরিবর্তে ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা সমর্থন করেছিল। আমি তখন একে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলেছি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বাম জোটের আন্দোলনের ফল বৃহৎ দলগুলোর পাদপদ্মে  উপহার দেবার মধ্য দিয়ে প্রচলিত বামদলগুলোর ভূমিকার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। প্রচলিত বাম দলগুলোর ইতিবাচক ভূমিকার আর কোনো সম্ভাবনা নাই। তবে তরুণরা নতুনভাবে চেষ্টা করছে। আমি তা সমর্থন করি। তবে পরিচিত অনেক ছোট ছোট বাম দলের মধ্যে হাসানুল হক ইনু কিম্বা রাশেদ খান মেননেরই অনুকরণ দেখি। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা চেয়ে এবং পেয়ে যারা নিজেদের বিক্রি করেছে, তাদেরকেই এখন অনেকে ছোট ছোট বাম দল রাজনীতির মডেল ধরে নিয়েছেন। তারা ভেবেছেন বিএনপি হয়তো ক্ষমতায় আসছে, তাই তারাও বিএনপির ইনু ও মেনন হতে চান। একটু ফার্স বা প্রহসন মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। স্বাধীন গণরাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলতে এরা আগ্রহী না। এদের কোনো ভবিষ্যৎ নাই।

বিএনপির সঙ্গে বিরোধী জোটের কর্মসূচি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাদের উচিত ছিল বিএনপিকে বোঝানো যে জনগণ বিদ্যমান ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন চায়, শুধু নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না। কিন্তু দেখুন তারা কী করে বেড়াচ্ছে। 

দ্য মিরর এশিয়া: ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলকে কীভাবে দেখেন

ফরহাদ মজহার: সাতচল্লিশে দেশ ভাগ হয়েছিল ধর্মীয় জাতিবাদের ভিত্তিতে। সেটা ছিল জাতিবাদের যুগ। হয়তো তা অনিবার্য ছিল। কিন্তু ভারত নিজেদের সেক্যুলার দাবি করলেও সাতচল্লিশ থেকেই ভারত ছিল হিন্দু রাষ্ট্র বা হিন্দুদের জন্য রাষ্ট্র। তাহলে আরএসএস বা হিন্দুত্ববাদের উত্থান মোটেও অবাক কোনো ব্যাপার না। বরং ভালো। কারণ বিশ্ব ভারতের আসল চেহারা দেখল। বাবরি মসজিদ ভাঙা, মুসলমান নির্যাতন, কাশ্মিরের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং নাগরিকত্ব বিলের মধ্য দিয়ে সকলেই সেটা দেখতে পাচ্ছে। এটা ভাল। মানবাধিকার সংগঠনগুলো অনেক দিন ধরেই হুঁশিয়ারি জানাচ্ছে যে ভারত ইসরায়েলের মতো আরেকটি গণহত্যার শর্ত  তৈরি করেছে। সেই দিক থেকে এবার বিজেপির ভোট কমে যাওয়া এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন এলায়েন্সের প্রত্যাবর্তন ভারতের জনগণের জন্য ইতিবাচক। ইউপি এবং বিশেষভাবে অযোধ্যায় বিজেপির হেরে যাওয়া ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক বার্তাই বহন করে। কিন্তু বাংলাদেশের ওপর দিল্লির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশকে দিল্লির কলোনি বানানোর প্রক্রিয়া কংগ্রেসের হাতেই ঘটেছে। ভারতের সেক্যুলাররা ভারতীয় সংবিধান বাঁচাবার যে চেষ্টা করছেন তার ইতিবাচক দিক ভারতীয়দের জন্য বুঝি। কিন্তু দিল্লি একটি আগ্রাসী শক্তি, কংগ্রেস ও সমমনাদের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের জন্য এমন কোনো বিশাল কোনো খবর না। আমরা প্রণব মুখার্জির রাজনীতি সম্পর্কে অবহিত। তবুও সর্বসাকুল্যে গণতান্ত্রিক ভারত আমাদের জন্য ভাল। সেই ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদ ও দিল্লি আমাদের জন্য বিপদের কারণ হলেও ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিবাচক সম্বন্ধ তৈরির কিছু সুযোগ হয়তো থাকবে। তবে এক হাতে তালি বাজে না। আমাদেরকেও দূরদর্শী এবং আন্তরিক হতে হবে। একালে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বা দেশ হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নাই। 

সেই দিক থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য বরং তৃণমূল কংগ্রেস অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক ও ইতিবাচক। তৃণমূল যেভাবে বিজেপিকে ঠেকিয়ে দিতে পারছে সেটা বাংলাভাষী ও বাঙালিদের বৃহত্তর স্বার্থের দিক থেকে ইতিবাচক। তৃণমূল পশ্চিম বাংলার সাধারণ মানুষের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে ধারণ করে। তৃণমূলের নানান সমালোচনা হতে পারে। মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে আমরা তিস্তার পানি পাইনি। বাংলাদেশ এটা মনে রাখবে। কিন্তু উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে বাঙালিসহ মণিপুর, ত্রিপুরা, আসাম বা সাতবোন নামে পরিচিত সবগুলো রাজ্যের জনগণের সঙ্গে আমাদের সৌহার্দ্য বৃদ্ধি জরুরি। হয়তো এই নির্বাচন তার পথ আরও সহজ করবে। আসন্ন নতুন বহুকেন্দ্রিক বিশ্বে উপমহাদেশীয় সৌহার্দ্য গড়ে তোলা আমাদের জন্য দরকার। এটা জিয়াউর রহমান বুঝেছিলেন। তিনি আন্তরিক ভাবেই সার্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এখন কি হবে জানি না। 

দ্য মিরর এশিয়া:  ফিলিস্তিন বিশেষত গাজার গণহত্যাকে কীভাবে দেখেন? কী ঘটবে? 

ফরহাদ মজহার : হামাসের আল আকসা তুফান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠার পরিষ্কার ইঙ্গিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক বিশ্বের পতন হতে চলেছে এটা পরিষ্কার। ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি, জর্দান ও অন্যান্য রাজতন্ত্রগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করবার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদী সেটলার কলোনিয়াল রাষ্ট্র ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়বে। ফিলিস্তিন জনগণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোর ভূমিকা এবং তুরস্কের দোদুল্যমান সুবিধাবাদী ভূমিকা সারা বিশ্ব দেখেছে। তার মানে মধ্যপ্রাচ্যের রাজাবাদশাহ ও  তাদের তেল কোম্পানিগুলোর আধিপত্য এখনকার মতো থাকবে কিনা বলা কঠিন।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নাই। কিন্তু আমরা এর সুবিধা পাব বলে মনে হয় না। কারণ আমরা স্টুপিড জাতি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ডলারের গ্রহণযোগ্যতা কমছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজরাজড়া ও রাজতান্ত্রিক শক্তিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এতোদিন টিকে ছিল। আল আকসা তুফান তথাকথিত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পরিস্থিতি এলোমেলো করে দিয়েছে। অর্থাৎ হামাস জিতেছে, এটা পরিষ্কার। কারণ হামাসের অব্যবহিত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির দ্বারা রাজতন্ত্রগুলোর টিকে থাকা এখন আগের চেয়েও কঠিন হয়ে যাবে। ভয়ের দিক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন বিশ্বকে ভয়াবহ ঝাঁকুনি না দিয়ে শেষ হবে না। আসলে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই কার্যত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেটা পরিণতি লাভ করবে মধ্যপ্রাচ্যে। ভীতির দিক হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সেটাই এখন দেখার বিষয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভরসার দিক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে তরুণদের বিদ্রোহ এবং যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইসরায়েলে বিনিয়োগ করা থেকে বিযুক্ত করবার আন্দোলন চলছে। তরুণরা ফিলিস্তিনী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করছে, গণহত্যার নিন্দা করছে। সেখানে ইহুদি ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপক অংশগ্রহণ করছে। অর্থাৎ জায়নবাদের বিরুদ্ধে ধর্ম ও মতাদর্শ নির্বিশেষে দৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠছে। এই বিক্ষোভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপসহ সারা বিশ্বে তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করবে এবং নতুনভাবে বিশ্বব্যবস্থার সংস্কার  বা নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন শক্তিশালী করবে। রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশে ‘ভাববৈঠকি’ এবং চিন্তা পাঠচক্রের মধ্য দিয়ে তরুণরা এই বৈশ্বিক লড়াইয়ে যুক্ত হচ্ছে। তরুণদের মধ্যে পঠনপাঠন সচেতনতা বাড়ছে। এই সব কিছুকেই আমি ইতিবাচক ভাবে দেখি। আমাদের কাজ করতে হবে। গুছিয়ে, লক্ষ্যে স্থির থেকে কিন্তু শক্ত ভাবে। দরকার দূরদর্শিতা। 

দ্য মিরর এশিয়া : আপনাকে দ্য মিরর এশিয়া'র পক্ষ থেকে ধন্যবাদ

ফরহাদ মজহার : আপনাকেও ধন্যবাদ।