এত উন্নয়নের গান গেয়ে এমন কোরামিন অর্থনীতি কারো কাম্য নয়: কেএএস মুর্শিদ

অর্থনীতিবিদ ডক্টর খান আহমেদ সাঈদ মুর্শিদ

ডক্টর খান আহমেদ সাঈদ মুর্শিদ (কেএএস মুর্শিদ) অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং শিক্ষাবিদ। তিনি কৃষি বাজার এবং গ্রামীণ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মহাপরিচালক হিসাবে অবসরে যান। গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন, সোলার হোম, অনানুষ্ঠানিক অর্থ, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য এবং ট্রানজিট, খাদ্যনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন। কেএএস মুর্শিদ দ্য মিরর এশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য মিরর এশিয়ার ঢাকা প্রতিনিধি। 

বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ কী বলে মনে করছেন? 

কেএএস মুর্শিদ: অর্থনীতিতে একবার ‘ম্যাক্রো ইমব্যালেন্স’ তৈরি হয়ে গেলে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সময় লাগে। ভারসম্য যদি একবার বিনষ্ট হয়ে যায়, তারপর পারফর্ম করতে সময় লেগে যায়। ম্যাক্রো (ইকোনমিক স্ট্যাবিলিটি) নিয়ন্ত্রণে সরকারের কাছে সম্পূর্ণ পলিসি আছে; এমনটা নয়। তবে কিছু কিছু আছে বলে মনে হয়, সেটা সরকার প্রয়োগ করবে। আমাদের এখানে মুদ্রানীতি দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়; কারণ এর পুরোটাই আমদানি নির্ভর সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের চাহিদার জন্য যে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে তা না, সাপ্লাই ব্যবস্থায় সমস্যা আছে। আমরা যেগুলো উৎপাদন করি এবং যেগুলো আমদানি নির্ভর, সেগুলোর সাপ্লাই চেইনে সমস্যা ঢুকে গেছে। কাজেই একটা-দুইটা পলিসি নিয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমানো যাবে না। সমস্যাগুলোকে আন্ডারলাইন (চিহ্নিত) করে, খুব দৃঢ়তার সঙ্গে করতে হবে।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন ছয় মাসের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি কমে আসবে। 

কেএএস মুর্শিদ: এটা তিন মাস, ছয় মাসের মধ্যে সমাধান হবে, এমনটা নয়। আস্তে আস্তে হলেও ক্রমশ কমে আসবে (মুদ্রাস্ফীতি)। কমতে থাকলে সে ইঙ্গিত আমরা পাব। আমরা আশা করতেই পারি। বাস্তবতা হলো একটি রূঢ় হবে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে, সাপ্লাই চেইনগুলোর যে সমস্যা আছে, তা মোকাবিলা করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিন্তু মুল্যস্ফীতি কমে আসছে। আমাদের দেশে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। এখানে কতিপয় গোষ্ঠী জড়িত। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন না। সিন্ডিকেট থাকতে পারে, বড় বড় আমদানিকারকদের হয়তো বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, সরকার এখানে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সুশাসন বিষয়টি অনেক বড়! আমাদের সুনির্দিষ্ট বিষয়ে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।

খাদ্যে মূদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষের প্রেটিনের চাহিদা চ্যলেঞ্জের মুখে পড়েছে? 

কেএএস মুর্শিদ: মানুষের হাতে টাকা নেই, প্রোটিনের চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে? মধ্যবিত্তরা একটা ভোগান্তির মধ্যে আছি, মুল্যস্ফীতি না কমলে ভোগান্তি আরো বেড়ে যাবে। অর্থনীতির প্রতি যে আস্থা, এটা দুর্বল হয়ে গেছে, এটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য অনেক কিছুই দায়ী। ওই কারণে আমরা আস্থাহীনতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। এখানে বলার আর কিছু নেই। আস্থাহীনতা যে কারণে হচ্ছে- সেখানে রাজনৈতিক কারণ আছে, অর্থনৈতিক কারণ আছে, জিও পলিটিক্যাল কারণ আছে। সব মিলিয়ে আমাদের আস্থাহীনতা দূর করতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের যে আস্থাহীনতা বেড়ে যাচ্ছে, এটাকে এড্রেস করা প্রয়োজন। না হলে যেটা হয়, বাজারেও এর একটা ইম্প্যাক্ট পড়ে। কারণ আমরা বুঝতে পারি, সরকার তেমন কিছু করতে পারে না, হয়তো সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও অনেক দুর্বৃত্তায়ন হয়ে গেছে অনেক পর্যায়ে, বাজারেও এটা প্রবেশ করে গেছে। বাজারও সেভাবে রিঅ্যাক্ট (প্রতিক্রিয়া) করে। দাম বেড়ে যায়, যারা কলাকুশলী, তারা সেটার সুযোগ নেয়। বাজারে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে - আস্থা ফিরিয়ে আনা। তার পরের কথা উৎপাদন বাড়ানো।

অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন কী হচ্ছে?

কেএএস মুর্শিদ: না, সবকিছুই প্রয়োজন। অবকাঠামো হচ্ছে ‘হার্ডওয়্যার’। যদি সফটওয়্যারটা (অর্থনৈতিক অবদান) না থাকে তবে ইনফ্রাস্ট্রাকচার কাজে আসবে কীভাবে। বড় বড় হাইওয়ে যদি বানাই, এটা ওভাবে ব্যবহার না হয়, সেটার যে বেনিফিট পাওয়ার কথা সেটা যদি না পাই, তাহলে আমাদের অন্য যায়গায় মনোযোগ দিতে হবে। ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ওপর যে নজরটা সেটা অনেক সময় রাজনৈতিক হয়, কারণ-দেখো এতো বড় জিনিস করলাম। এই যেমন, ড্যাম তৈরি হলো, হাইওয়ে তৈরি হলো; এগুলোর ভিজুয়াল ইমপ্যাক্ট অনেক বড়। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এগুলো পছন্দ করেন। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পের সফটওয়্যার যেগুলোকে বলি, সেগুলো দেখা যায় না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুশাসন, বিভিন্নভাবে বাজারকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা-এগুলো অতটা দৃশ্যমান না হলেও, এগুলো ছাড়া শুধু অবকাঠামো দিয়ে উন্নয়ন হবে না, সবগুলোই লাগবে। আমাদের অর্থনীতির ভারসম্য ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে যেটা করতে হবে, ভাবতে হবে মানুষের জন্য ‘সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন’ কোন প্রকল্পের, সেটা নেয়া। সেখানেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে প্রজ্ঞা, সেটা প্রতিফলিত হবে।

রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে খেলাপি ঋণ বাড়ছে?

কেএএস মুর্শিদ: বিষয়টা বহুদিন ধরে চলে আসছে। (খেলাপি ঋণ) যে পর্যায়ে চলে গেছে, এখন সেটা আর সাস্টেনেইবল না। পদক্ষেপ নিতেই হবে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংককে যারা কিছু দিতে (দক্ষতা অনুযায়ী) পারবে, তাদেরই নিয়োগ দেওয়া এবং সুনির্দিষ্ট একটা রোডম্যাপ থাকতে হবে যে, আমি আগামী তিন মাসে এ জায়গায় পৌঁছাব, ছয় মাসে এই জায়গায়। আমাদের ব্যাংকগুলোকে সুরক্ষ দেওয়া প্রয়োজন। একে অযাচিত প্রভাবমুক্ত করা প্রয়োজন। ব্যাধিটা এমন ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাংকে, এটা আর সহনীয় লেভেলে নেই। যদি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, এর (অর্থনীতির) ধস নেমে যাবে। সিগন্যাল পাচ্ছি, অনেক খাত থেকে। কিন্তু আমরা রিঅ্যাক্ট করছি না। 

ব্যাংকের বড় খেলাপি ঋণগুলো আট-দশটা বড় গ্রুপের কাছে বন্দী; তারা সরকারের ছত্রছায়ায় অনৈতিকভাবে ব্যাংক ঋণ রিশিডিউল সুবিধা পাচ্ছে, এমন অভিযোগ রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

কেএএস মুর্শিদ: ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণে যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন আমরা কতটা দেখছি? যারা আমাদের ব্যাংকগুলোতে লিড দেন, খেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের সাহস দিতে হবে (সরকারকে)। সে সমর্থন যদি না দেওয়া হয়, তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব না। এখন আমরা একটা ভিসিয়াস সাইকেলের মধ্যে পড়ে গেছি। ভিসিয়াস সাইকেল থেকে আমাদের বের হতেই হবে। আট, দশটা-যে কয়টা হোক (ঋণখেলাপি), তাদের নিরস্ত্র করতে হবে। আমরা বাজার অর্থনীতির কথা বললেও, এটা আর বাজার অর্থনীতি না। এটা হয়ে গেছে ক্রিমিনালাইজ ইকোনমি। যাকে আমরা দুর্বৃত্তায়নের অর্থনীতি বলতে পারি। এখানে প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত নয় সবার জন্য।

বেসরকারি খাতে বড়দের চাপে ছোটরা ঢুকতে পারে না, এর কারণ কি?

কেএএস মুর্শিদ: তারা ঋণ পায় না। ২৪ পরিবার দেশ নিয়ন্ত্রণ করেছে পাকিস্তান আমলে, এখন পঞ্চাশটা পরিবার আছে, যারা দেশটা নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কী ধরনের বাংলাদেশ চাই, মৌলিক জায়গায়ও গণ্ডগোল আছে। আমরা একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম একাত্তর সালে, এখন সে বাস্তবতা দূরে থাক, আমাদের কল্পনার মধ্যেও নেই। 

সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে এসেছে কি না? 

কেএএস মুর্শিদ: অনেক দূরে সরে এসেছে। আপনি কী চান, সেট স্পষ্ট করতে হবে। আমরা এমন বাংলাদেশ চাই না, সেটা মনে হয় ভেরি ক্লিয়ার।

আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে? 

কেএএস মুর্শিদ: এটা (আইএমএফের ঋণ) অর্থনীতির একদম শেষ পর্যায়ে এসে, কোরামিন (বিশেষ ইঞ্জেকশন) দেওয়ার মতো। এত উন্নয়নের গান গেয়ে এমন কোরামিন অর্থনীতি কারো কাম্য নয়। অনেক দুঃখ পাই আমরা। এখন কেমন জানি মনে হয়, আমরা যাত্রা বিরতিতে আছি। আমরা এখন জানছি বেনজীর, আজিজসহ নানা দুর্নীতিবাজদের ইস্যু। এত ডিজিটাল স্পাই করার যন্ত্র, কেউ কিছু আগে জানতে পারেনি? তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে, রাষ্ট্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠান ধ্বাংস হয়ে গেছে। কোনো প্রতিষ্ঠান কার্যকর নেই। এসব দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতার ভেতরেই বেড়ে উঠেছে। কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা গেল না। তাহলে কি টোটাল সিস্টেমটাই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে? 

প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো?

কেএএস মুর্শিদ: এটি একটি কাল্পনিক বাজেট। বাজেটে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়, তিন মাস পরে তার রিভাইস করতে হয়, বাস্তবায়নই তো হয় না, মন্তব্য করে কী লাভ।

আপনাকে ধন্যবাদ। 

কেএএস মুর্শিদ: দ্য মিরর এশিয়াকেও ধন্যবাদ।