এই সরকার ১৮ কোটি জনগণকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে

কমরেড সাইফুল হক একজন রাজনীতিক। তিনি বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশের এই ফ্যাসিবাদকালে রাজনীতির পরিমণ্ডলে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামের একজন অন্যতম যোদ্ধা। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই-এর কর্মকৌশল ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি, ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণআন্দোলনের কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ। দ্য মিরর এশিয়া'র সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি-

দ্য মিরর এশিয়া: সম্প্রতি শেখ হাসিনার ভারত সফর করেছেন এবং সেখানে ভারত সরকারের সাথে ১০টি সমঝোতা স্মারক চুক্তি করেছেন। এ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।

সাইফুল হক: এই সফরে শেখ হাসিনা-মোদির মধ্যে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে—তাতে প্রথমত ইন্ডিয়ান অ্যাজেন্ডাটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশের ছোটখাটো দু' একটি বিষয় ছাড়া অধিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এই শীর্ষ বৈঠকে অগ্রাধিকার পায়নি। এটা কোনো মনযোগের ভেতরে আসেনি। সে জায়গা থেকে বলতে পারেন, বাংলাদেশের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জোনটা ছিল, বিশেষ করে তিস্তাসহ আমাদের অভিন্ন নদীর পানি—আমরা বহু বছর ধরে ঝুলে থাকা আমাদের ন্যায্য হিস্যা আমরা নিশ্চিত করতে পারব কি-না। আবারও এটা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো আলোচনাই হয়নি। বরঞ্চ পরোক্ষভাবে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টা কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে। এটাকে একভাবে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকটা গরু মেরে জুতো দান করার মতো অবস্থা।

তিস্তা পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে চীনের আগ্রহের কারণে ভারত তখন পাল্টা আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। এটা একান্ত আমাদের বিষয় এবং খেয়াল করবেন যে, প্রধানমন্ত্রী পরশু দিন যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন; সেখানে খুবই স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। প্রথমত বললেন যে, চীন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। ভারত প্রস্তাব দিয়েছে। জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় আমরা ঠিক করব যে, আমরা কোনটা করব। আবার একই সম্মেলনে বললেন, ভারত যদি করে দেয় তাহলে তো আমাদের জন্য খুবই ভালো হয়। তার মানে হচ্ছে যে, তার বক্তব্যের মধ্যে কোনো সংগতি নেই। একেবারে পুরোপুরি স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। ভারতকে তারা যে দিতে চাইছে—তার বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সেটা বেরিয়ে আসছে। অর্থাৎ পানি বণ্টনের বিষয়টা ঝুলেই থাকল। একভাবে এটাকে অস্বীকার করে ব্যবস্থাপনার নামে একটা অচল অবস্থার দিকে দেশটা নিয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত আমাদের অগ্রাধিকার ছিল সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে কি-না। এবং সীমান্ত হত্যার ব্যাপারে শীর্ষ বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনি কি সমঝোতাও কিছু হয়নি। মিটিংয়ের পরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা প্রেস ব্রিফিং করেছেন। সেখানে বরঞ্চ তিনি যে কথা বললেন, তাতে ধরে নেয়া হচ্ছে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড চলতে চলতেই থাকবে। কথাটা কেন বললাম? কারণ, তিনি বলেছেন যে সীমান্তে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়—সেখানে বিএসএফ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। তার মানে পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়; বরং এটা যে চলবে তার ইঙ্গিতটা মোটামুটি বেরিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী দিল্লি থেকে ঢাকায় আসার দু’দিনের ব্যবধানে গত পরশু রাতে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নুরুল ইসলাম নামে একজন নিহত হন।

তৃতীয়ত আমি বলছি যে, বাণিজ্যের ভারসাম্যের যে প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি, ভারতের নানা ধরনের ট্যারিফ এবং নন-ট্যারিফ তাদের যে বাধা বাণিজ্যের জন্য তা-ও উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের পণ্যগুলো ঠিকমতো ভারতের বাজারে ঢুকতে পারে না। এগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বরঞ্চ আমরা দেখছি, পুরো ব্যাপারটা, বিশেষ করে ভারতকে রেলের জন্য যে করিডোর দেওয়ার একটা চুক্তি করা হয়েছে; সেটা আমাদেরকে গভীরভাবে উদ্বেগ করেছে। বিষয়টা খুব অস্পষ্ট, তারা বাংলাদেশের বিশাল ভূখণ্ড ব্যবহার করবে এই রেল করিডরের জন্য। বিশেষ করে, বাংলাদেশের উত্তরে যে চিকেন লেক; তার সেভেন সিস্টারের সাথে ভারতের যোগাযোগটা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের প্রায় ২ শত কি.মি. বা তার চেয়ে বেশি সড়কপথ তারা ব্যবহার করবে রেলের মধ্যে দিয়ে। অথচ বাংলাদেশের সাথে নেপালের সড়ক দূরত্ব মাত্র ১৮ কি. মি.। যেটা আমরা যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা সেটা দেইনি। বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটানের সাথে আমাদের সড়ক যোগাযোগের জন্য এই পর্যন্ত সেটা ঝুলে আছে। অথচ, আমরা তাদেরকে কয়েক শত কি.মি. সড়ক ট্রানজিট দিয়েছি, আমরা স্থলভাগে করিডোর সুবিধা দিয়েছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমরা দেখছি তারা আমাদের নতুন বিষয়টা আমলে না নিয়ে যথেচ্ছো বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করছে।

আরেকটা বিষয় আপনারা খেয়াল করবেন, এবারে সমঝোতা স্মারক চুক্তির মধ্যে তারা বলছে যে, আমাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন— এমনকি আমাদের অস্ত্রপাতি কেনা শুরু করে তাদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এটাও ভারত এক ধরনের সমঝোতার জায়গায় তারা আসছে। সেটা আমাদের জন্য খুবই বিপদজনক। আমাদের সার্বভৌমত্ব, জাতি নিরাপত্তা একমাত্র ভারতের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি হুমকি। তারা যদি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সামরিক শিক্ষা আধুনিকায়ন; এমনকি আমার অস্ত্র কেনার জায়গায়ও যদি ভারত ঢুকে যায়, তখন জাতীয় নিরাপত্তার গোপনীয় বিষয়গুলো ভারত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই ঢুকে যাওয়ার পরিস্থিতি ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। যেটা আমাদের নিরাপত্তা ভবিষ্যতের জন্য খুব উদ্বেগের। চীন থেকে নেওয়া আমাদের দুটো সাবমেরিন আছে বঙ্গোপসাগরে। ভারত তার আগে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রাডার তৈরি করেছে। এখন তারা মোংলা বন্দরকে ব্যবহার করে পুরো ভারত মহাসাগরে এক ধরনের বাড়তি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার একটা চেষ্টা আমরা দেখছি। যৌথ স্যাটেলাইট তারা পাঠাবে, আলোচনা হচ্ছে সমঝোতার মধ্যে। তার মানে আমাদের বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ যা কিছু আছে; এই যৌথ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভারতের নজরদারি এবং তার আওতার মধ্যে বাংলাদেশ থাকবে। আর দেখবেন, উত্তরাঞ্চলকে কেন্দ্র করে যা কিছু উজ্জ্বল সবটা নেয়া হয়েছে ভারতের ট্রানজিট এবং ভারতের পণ্য পরিবহন সুবিধার জন্য। তারা ট্রেনে পণ্য পরিবহন করবে নাকি অস্ত্র পরিবহন করবে, এটাতো আমরা জানি না। এটা নিয়ন্ত্রণ করবে কে? এটা তদারকি করবে কে? এটার গার্ড কারা? এটা কারা কি করবে—এই বিষয়গুলো অস্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারতকে তো আমরা সবকিছু খুলে দিয়েছি। ভারত বাংলাদেশ থেকে যে সুযোগ পাবে তা তাদের পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু বাংলাদেশ কী একই ধরনের সুযোগ পায়!

আমার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, আমার অর্থনীতি উন্নয়নের ক্ষেত্র থেকে শুরু করে কিন্তু পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে একপক্ষীয়। চীন বিদ্রোহী ভারতের সাথে যে অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক জোট গড়ি না কেন তার সাথে আমেরিকা, বিশেষ করে ভারত যুক্ত। বাংলাদেশকে তারা একটি চীন বিরোধী দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমুদ্রসীমাকে যেমন নিতে চাইছে; তেমনি বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে সড়ক পথে, রেল পথে, পুরো পথকে নেওয়ার একটা চেষ্টা আমরা লক্ষ্য করছি। এ প্রসঙ্গে শেষ কথা বলি, এরকম জায়গায় সরকার গেল কেন? কারণটা হচ্ছে, বাস্তবে এ সরকার যেহেতু টানা ১৫ বছর ভারতের মদদে ক্ষমতায় আছে। ফলে ভারতকে তারা বাস্তবে পুরস্কার হিসাবে আমাদের সমস্ত কিছুকে চাওয়া মাত্র দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এই সরকার এবং সরকারী দল জাতীয় স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করছে না। তারা ভারতের স্বার্থেই বাংলাদেশে কাজ করছে। ফলে আমরা বলি, আমার নির্বাচন, আমার ভোটাধিকার, আমার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ কোনো কিছুতেই নিরাপদ নই। একই সাথে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতিও নিরাপদ নয়। এটা আজকে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির ভেতরে।  সত্যি সত্যি এ সরকার এক ধরনের পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে। ভারত একটা অনুগত পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটা শাসননীতি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে।

দ্য মিরর এশিয়া: ক্ষমতা ও দুর্নীতি কে কাকে প্রভাবিত করে? নাকি এ দুটি রাজনীতির যমজ সন্তান?

সাইফুল হক: বাংলাদেশে ক্ষমতা আর দুর্নীতি প্রায়ই হরিহর আত্মা। এরা প্রায়ই ঘনিষ্ঠ। এখানে ক্ষমতায় থাকা মানে তারা মনে করে বেহেশতে থাকা। বিরোধী দল থাকা মানে দোজখের গজবের সামিল। এ জন্য তারা ক্ষমতার বাইরে থাকতে চায় না। ক্ষমতার সাথে দ্রুত অর্থবিত্ত গড়ে তোলার একটা সম্পর্ক আছে। আমাদের এখানে দুর্নীতি আগেও ছিল, কিন্তু বিভিন্ন মাত্রায়। কিন্তু এই আমল অতীতের সকল আমলকে লজ্জা দিয়েছে। কেন? গত ১৫ বছর সরকার টিকে আছে ভোটবিহীন গায়ের জোরে জবরদস্তি করে। আমলাতন্ত্র, প্রশাসন, পুলিশ, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদের উপর নির্ভর করে এক ধরনের অবৈধ দখলদারিত্ব অব্যাহত রেখেছে সরকার। ফলে সরকার ক্ষমতায় থাকার বিনিময়ে এদেরকে যা খুশি করার একটা লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। বাস্তবে এরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সরকার, সরকারি দল এবং গোটা দুর্বৃত্তরা বাস্তবে একটা সিন্ডিকেট। বাংলাদেশে আসলে কোনো রাজনৈতিক সরকার দেশ চালাচ্ছে না। গোটা মাফিয়া, দুর্বৃত্ত এবং দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট তারা। এখন একটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো বাংলাদেশকে টার্গেট বাজারে পরিণত করেছে। বলপ্রয়োগ ও দমন করে শাসন করতে গিয়ে এখানে একটা মাফিয়া রাজত্ব কায়েম করেছে। ফলে দেশে নৈরাজ্যের অবস্থা দেখা দিয়েছে। এবং আমি খুব উদ্বিগ্ন, যদি এভাবে চলতে থাকে বাংলাদেশ অচিরেই আফ্রিকার কোনো ‘ফেল স্টেটে’র মতো একটা অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার ট্রেন্ড ও প্রবণতাগুলো স্পষ্ট।

দ্য মিরর এশিয়া:  বাংলাদেশ আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা কী আক্রান্ত?

সাইফুল হক: আক্রান্ত তো বটেই। বিশেষ করে, আমাদের পাশে যে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত—তারা তো বাংলাদেশকে একটা স্বাধীন-সার্বভৌম আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চায় না। তারা এখানে একটা অনুগত সরকার দেখতে চায়। এবং সেজন্য আওয়ামী লীগ তাদের জন্য অনেক বেশি উপযোগী। ফলে এখানের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দু’একটি ছাড়া গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ যাতে তাদের অধীনে চলে; সে তৎপরতা আমরা লক্ষ্য করি। ভারত এমনই এক প্রতিবেশী আমার সীমান্তের তিনদিকে সাড়ে চার হাজার কি. মি. কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছে। সেই প্রতিবেশী, যে প্রতিবেশীকে ঢাকায় হয়তো ৭১’র ভূমিকার জন্য ফুল দিয়ে সংবর্ধনা দিচ্ছি;

একই দিন হয়তো দেখা যাবে সীমান্তে বিএসএফ মানুষকে হত্যা করছে। তারা (আওয়ামী লীগ) বলছে তাদের বন্ধুত্ব নাকি সর্বোচ্চ শিখরে। অথচ, বন্ধুত্বের এই দায় মেটাতে হচ্ছে প্রতিদিন সীমান্তে রক্ত দিয়ে। পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্ত এতো ভয়ংকর না—একমাত্র ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্ত ছাড়া। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ ঠান্ডা মাথায় বাংলাদেশিদেরকে হত্যা করছে। এটা মৃত্যু উপত্যকা সীমান্ত। ফলে বাংলাদেশে আধিপত্যবাদী কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গিয়ে বাংলাদেশকে প্রায় গলা টিপে ধরার একটা তৎপরতা আমরা আগাগোড়া লক্ষ্য করেছি। আর এই সরকার যে কোনো মূল্যে, বলে না; জুয়াড়ি যখন উন্মত্ত হয়, উন্মত্ত হতে হতে সবকিছু যখন হারিয়ে ফেলে, তখন সে বউ-বাচ্চাকে জুয়াকোটে তোলে, তেমনি এই সরকার ১৮ কোটি জনগণকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। এদের হাতে বর্তমান, ভবিষ্যৎ কোনো কিছুই নিরাপদ নয়।

দ্য মিরর এশিয়া: তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ডাক্তার বলছেন, তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে নির্বিকার ও নানা তাল-বাহানা করছে। এ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

সাইফুল হক : খালেদা জিয়া তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দেশের এখন বিরোধী দলের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। বিএনপি’র চেয়ারপারসন। সুতরাং তাকে তো সরকার ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। খালেদা জিয়ার যে বিচার, আমি মনে করি—এটা দুর্নীতির বিচার না। এটা রাজনৈতিক বিচার। সরকার তার রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে একটা ফরমায়েশি সাজানো মামলা দিয়ে তারা তাকে ইতোমধ্যে কারাদণ্ড দিয়েছে এবং ৫ বছরের কারাদণ্ড উচ্চ আদালতে এসে ১০ বছরে বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুরোটাই হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে খালেদা জিয়াকে নিঃশেষ করে দেওয়া। আর এই দণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। খালেদা জিয়াকে মূলত রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে বাস্তবে সরিয়ে দেওয়া। এটা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রতিহিংসার যে রাজনীতি,  প্রতিশোধের যে রাজনীতি—এটা তারই হয়তো সবচেয়ে উলঙ্গ, সবচেয়ে অশ্লীল, সবচেয়ে জঘন্য একটা বহিঃপ্রকাশ। এটা করতে গিয়ে, ধরুন, খালেদা জিয়ার যদি দুর্ঘটনাক্রমে মৃত্যু ঘটে। তখন এটার ভার হবে অনেক বেশি। সরকার এই ভার সামাল দিতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। দেশের রাজনীতির মধ্যে যেখানে একটা সংলাপ দরকার ছিল, সমঝোতা দরকার ছিল, আলাপ-আলোচনা করে একটা অবাধ বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দরকার ছিল; সে পথে আওয়ামী লীগ না হেঁটে প্রতিহিংসার রাজনীতি করে, খালেদা জিয়াকে বন্দি করে তাদের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে। এটা তাদের জন্য এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। বাস্তবে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কোনো প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

দ্য মিরর এশিয়া: একটা ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানোর জন্য বিএনপিসহ আপনারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিচ্ছেন। এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি কর্মসূচি দিয়ে কি আদৌ বিদ্যমান সংকট ফয়সালা সম্ভব?

সাইফুল হক : আমি আপনার সঙ্গে একমত। বলে না যে, যশমিন দেশে যদাচার। যেই দেবতা যেই প্রসাদে তুষ্ট, সেই দেবতাকে সেই প্রসাদ না দিলে তিনি আসলে সন্তুষ্ট হবেন না। ফলে বিরোধী দল কী কৌশল নেয়, কোন কৌশল নেওয়া উচিত —এটা পরোক্ষভাবে অনেক সময় সরকার কিন্তু ঠিক করে দেয়। সরকার আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক, দমন করে শাসন করার নীতি কৌশল অবলম্বন করেছে। আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নামছি ঠিক, কিন্তু এই মানুষকে প্রতিরোধের শক্তি হিসাবে রাজপথে দাঁড় করাতে সক্ষম হচ্ছি না। এই দুরাচারী এই ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে একটা সিদ্ধান্তমূলক লড়াই ছাড়া কিছু করতে পারব না বলে আমি বিশ্বাস করি।

৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান-বর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ সরকারের প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করেছে। এই গণ-অনাস্থাকে কর্মসূচি আকারে রাজপথে নিয়ে আসতে পারাটাই এখন বিরোধীদলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেই কাজটা শুধুমাত্র সুশলি বালক হয়ে করার মধ্যে কোনো অর্থ নেই। সরকার যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বলপ্রয়োগের নীতি হিসাবে নিয়েছে; জনগণের পক্ষ থেকে পাল্টা বলপ্রয়োগ করা ছাড়া এই সরকারকে আমরা বিদায় নিতে বাধ্য করতে পারব না। মানুষ কীভাবে বলপ্রয়োগ করে? মানুষ বলপ্রয়োগ করে গণ-আন্দোলন, গণ-জাগরণ এবং একটা গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে। সম্ভবত বাংলাদেশকে সে পথে যেতে হবে। আমরা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে শান্তিপূর্ণ ফর্মটা অনুসরণ করতে চাই। কিন্তু সরকার যদি বাধ্য করে তখন জনগণকে সাথে নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকবে না।

দ্য মিরর এশিয়া: আপনাকে ধন্যবাদ।

সাইফুল হক: তোমাকেও ধন্যবাদ।