আসছে অলিগার্কদের সুবিধা দেওয়ার বাজেট 

চতূুর্থবার ক্ষমতায় আসার পর চলতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণায় মধ্যে দিয়ে দেশের অলিগার্কিদের নানা সুবিধা দেওয়া হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আসন্ন প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কর অব্যাহতি সুবিধা, বিদ্যুত খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ, কালো টাকা সাদা করাসহ নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা তাদের দিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার।

অলিগার্কি প্রাচীন গ্রীক থেকে আসা শব্দ যার অর্থ হচ্ছে  ‘কয়েকজনের শাসন’। অন্যভাবে বলা যায়, অলিগার্কি হচ্ছে ক্ষমতা কাঠামোর একটি ধারণাগত রূপ যেখানে ক্ষমতা অল্পসংখ্যক লোকের কাছে থাকে। এই মতধারার রাজনীতিতে ছোট একটি গোষ্ঠী শাসকের ভূমিকায় থাকে। বিগত ১৫ বছরের শাসনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে অলিগার্কির মধ্যে রয়েছে সামিট, এস আলম, বেক্সিমকো , ওরিয়ন এবং বসুন্ধরা ।

অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক সরকার টিকে থাকতে তাদের অলিগার্কিদের আগামী বাজেটে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা দেবে। এ সরকার বড় ব্যবসায়ী যারা  ১৫ কোটি টাকার গাড়ি চালায় তাদের ওপর খুব কম ট্যাক্স আরোপ করে। এ দেশের বড় লোকরা কর দেয় না। এ সরকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ওপর অনেক ধরনের কর ও ভ্যাট সহজেই চাপিয়ে দেয়। পেশাজীবিদের ওপরও এ সরকার কর আরোপ করে থাকে। কারণ তাদের কাছ থেকে এ কর আদায় করা খুবই সহজ ।

তিনি আরো বলেন, সরকারের অলিগার্কিদের সবচেয়ে সুবিধাজনক প্রস্তাব হচ্ছে কালো টাকা সাদা করা। কালো টাকা সাদা করা বিষয়টা দেশের কর সিস্টেমকে একবারে নষ্ট করে দিচ্ছে। একজন ধনী লোক ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকা সাদা করে, অন্যদিকে একজন ছোট ব্যবসায়ী  ২০ শতাংশ ট্যাক্স কেন দেবে ?

রেজা কিবরিয়া বলেন, এসআলম দখল করে নেওয়া ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে অর্থ সংকট কমাতে কাজ করে যাচ্ছে। এ  ছাপানো টাকা জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির বোঝা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যা এক ধরনের কর।

কর অব্যাহতি

জানা গেছে, আগামী বছর অর্থ বছর আন্তজাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বর্ধিত সহায়তাসহ ৪৭০ কোটি ডলারের চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া বেশ কিছু শর্তের মধ্যে কর অব্যাহতি বা ব্যয়কে যৌক্তিককরণ করতে বলা হয়েছে। অলিগার্কির স্বার্থ বিবেচনায় সরকার আগামী অর্থ বছরে বাজটে কর অব্যাহতির সুবিধা কাজে লাগাচ্ছে। কর অব্যাহতি বলতে মোট করযোগ্য আয় থেকে– রেয়াত, ছাড়, হ্রাসকৃত হারে কর প্রদান এবং আয় বাদ দেওয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে ।

রেমিট্যান্স, বেতন, শেয়ারের মূলধনী আয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, ডিভিডেন্ট, কৃষি ব্যবসা, সঞ্চয়পত্রের সুদ, সম্পদ হন্তান্তর বা বিক্রি থেকে অর্জিত আয়, রপ্তানি খাত, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষাসহ বর্তমানে প্রায় শতাধিক খাত কর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছে। অলিগার্করা মূলত এসব খাতে ব্যবসা করে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৭ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে রয়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ ভ্যাট) আয়কর এবং আবগারি শুল্ক।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, কর ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর পরিকল্পনা সত্ত্বেও মোট অব্যাহতি হতে পারে গত অর্থ বছরের রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার প্রায় কাছাকাছি বা প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর-এর হিসাবে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে মোট অব্যাহতরি প্রক্ষপেণ করা হয়ছেে ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। যার অর্থ এসআলম, বসুন্ধরা , সামিট, বেক্সিমকো আগের মতো আগামী অর্থবছরেও কর অব্যাহতি সুবিধা পাবে ।

করপোরেট কর

অলিগার্করা আরেকটি আর্থিক সুবিধা পাবে আসছে বাজেটে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নতুন করে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির জন্য এ হার কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। তবে শর্ত সাপেক্ষে এই সুবিধা দেওয়া হবে। শর্তের মধ্যে থাকবে, একক লেনদেনে ৫ লাখ টাকা এবং বার্ষিক সর্বমোট ৩৬ লাখ টাকার বেশি খরচ ও বিনিয়োগ হলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে। বর্তমানে দেশে এ ধরনের শর্ত পরিপালনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে করপোরেট করহার সাড়ে ২৭ শতাংশ।

নিত্যপণ্য সরবরাহের উৎসে কর অব্যাহতি

আগামী বাজেটে বাজার স্থিতিশীল রাখা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্তত ৩০ পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর কমানো হচ্ছে। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব পণ্যে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বসুন্ধরা খাদ্যপণ্যের কর কমানো সুবিধা ঠিকই আদায় করে নেবে। এসআলমও এ সুবিধা নেবে। এ দলে রয়েছে সরকার ঘনিষ্ঠ মেঘনাও। বাজেটে এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলেও ভোক্তারা খাদ্যপণ্য আগের চেয়ে কমমূল্যে কিনতে পারবেন সে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না কেউ । বিসিএস তথ্য অনুসারে, বর্তমানে  দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সরবরাহ উৎসে কর কমবে এমন পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, মটর, ছোলা, চাল, গম, আলু, মসুর, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, গোলমরিচ, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতা এবং সব ধরনের ফলসহ ৩০ পণ্য।

অন্যদিকে প্যাকেটজাত গুঁড়াদুধ আমদানিতে কর হার কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আড়াই কেজি ওজন পর্যন্ত গুড়াদুধের ওপর কর হার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ করার প্রস্তাব আসছে। বর্তমানে গুঁড়াদুধের বাল্ক আমদানিকারকদের জন্য মোট কর হার ৩৭ শতাংশ।

কালো টাকার সাদা সুবিধা

প্রশ্ন ছাড়াই মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। মূলত অপ্রদর্শিত অর্থ অর্থনীতির মূলধারায় আনতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পুরোনো আয়কর আইনের ধারা বর্তমান আইনে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা করছে এনবিআর। এ পদ্ধতিতে কর দিয়ে টাকা বৈধ করলে সরকারের অন্য কোনো সংস্থা উৎস নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না। অভিযোগ আছে দেশে আওয়ামী লীগ সরকারের অলিগার্কি বসুন্ধরা, বেক্সিমকো এবং ওরিয়ন গ্রুপ নানাভাবে এ সুবিধা আগামী বাজেটে রেখে দেওয়া জন্য চাপ দিচ্ছে। সেই চাপের কারণে  আগামী বছর সরকার এ সুবিধা অব্যাহত রাখতে চায়।  

এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার মাত্র ১০ শতাংশ কর পরিশোধে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগের পাশাপাশি সহজ শর্তে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরাতেও বাজেটে দায়মুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়। এ ধরনের উদ্যোগকে বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একে সাধারণ করদাতাদের ওপর অবিচার উল্লেখ করে বাজেটে এ ধরনের সুবিধা না রাখার পরামর্শ দেন তারা।

চার বছর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ ও ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বর্গমিটার প্রতি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট কেনার সুযোগও ছিল। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওই অর্থবছরে ১১ হাজার ৮৩৯ জন ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করেন, যা ছিল দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ কালো টাকা সাদা করার ঘটনা। এসব বিনিয়োগ থেকে ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। এর মধ্যে ৭ হাজার ৫৫ জন ব্যাংকে জমা বা নগদ ১৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা বৈধ করেন। বাকি টাকা জমি, ফ্ল্যাট বা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়। এর পরের বছর কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে সাড়া না পাওয়ায় এ সুবিধা বাতিল করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশ থেকে অঘোষিত অর্থ দেশে আনার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সে সুযোগও সেভাবে গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তাই পরের অর্থবছর এ সুযোগ আর রাখা হয়নি।

জানা গেছে, আগামী বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। মূলত কালো টাকাকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে এ উদ্যোগ। সরকারের অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না। বর্তমানে ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ কর হার ২৫ শতাংশ, যা আগামী অর্থবছরে ৩০ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে এনবিআর।

ক্যাপাসিটি চার্জ ও জ্বালানি তেলের দাম

সামিটের আটটি কেন্দ্রের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট, যা বেসরকারি খাতের প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। যদিও নানা কারণে কেন্দ্রগুলো বছরের প্রায় অর্ধেক সময় বসে থাকে। তবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়মিত ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)।
সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৪ বছরে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপ ও এর বিভিন্ন পরিচালকের কাছে। এর মাধ্যমে আরও প্রায় এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে গ্রুপটির কাছে। সব মিলিয়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে সামিট গ্রুপ। বাজেটে ঘোষণায় আগামী বছরও  ক্যাপাসিটি চার্জের সুবিধা অব্যাহত রাখবে এ সরকার ।

অপরদিকে বসুন্ধরা বসুন্ধরার জ্বালানি তেল আমদানি যাতে লাভজনক হয়, সে জন্য ভারতে সাথে সমন্বয় করে বাংলাদেশে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এলএনজি এবং ভোজ্যতেল আমদানিতে সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়েছে বসুন্ধরা।  

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট নির্বাহী পরিচালক  আহসান এইচ মনসুর দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, আর্থিক খাত ও রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। বাজেটে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা থাকা উচিত। ধনী আর বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর ট্যাক্স না বসিয়ে গরীব আর মধ্যবিত্তের ওপর কর বসিয়ে বেশি দিন চলা যাবে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলো যেভাবে চলছে, সেভাবে আর চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। টাকা ছাপিয়ে কিছু ব্যাংক চালু রাখার যে ব্যবস্থা চলছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা থাকা দরকার বাজেটে। এমনিতে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে।