পৌনে দুই হাজার কোটি টাকার রেলপথে একটিমাত্র ট্রেন!

পৌনে দুই হাজার কোটি টাকার রেলপথে একটিমাত্র ট্রেন!

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ঈশ্বরদী-ঢালারচর ৭৮ কিলোমিটারে রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা। অথচ এ রুটে একটিমাত্র ট্রেন চলাচল করছে। অথচ রেলপথটি নির্মাণের লক্ষ্য ছিল পাবনার সঙ্গে ঢাকার ট্রেন চলাচলের পাশাপাশি স্থানীয় গন্তব্যগুলোতে পর্যাপ্ত যাত্রীসেবা দেওয়া। কিন্তু বিপুলসংখ্যক যাত্রীর চাহিদা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, এই রেলপথে তাদের আরো ট্রেন চালানোর ইচ্ছা আছে। কিন্তু নানা সংকটের কারণে তা পারছেন না।

জানা গেছে, ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেলপথে চলা একমাত্র ট্রেনটি সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে ঢালারচর থেকে ছেড়ে সকাল ১১টায় রাজশাহী পৌঁছায়। একই ট্রেন বিকেল সাড়ে ৪টায় রাজশাহী থেকে ছেড়ে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে ঢালারচর পৌঁছায়। এভাবে দিনে দুইবার এবং সপ্তাহে ছয়দিন চলে ট্রেন। এছাড়া ঐ রেলপথে ১০টি স্টেশন রয়েছে। দেখভালের অভাবে বেশির ভাগই একরকম অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন লাইন নির্মাণ’ শীর্ষক এই প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে মোট এক হাজার ৭১৪ কোটি টাকার বেশি। ব্যয়ের শতভাগ অর্থই সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

২০১৩ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর প্রথম ধাপে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঈশ্বরদী-পাবনা ৩০ কিলোমিটার রেলপথের কাজ শেষ হয়। ঐ বছরের ১৪ জুন এই ৩০ কিলোমিটারে রাজশাহী-পাবনা রেলপথের ‘পাবনা এক্সপ্রেস’ নামে একটি ট্রেন চালু করা হয়। এরপর পুরো কাজ শেষে ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি রেলপথটি চালু করা হয়। তখন ‘পাবনা এক্সপ্রেস’ ট্রেনের নাম বদলে রাখা হয় ‘ঢালারচর এক্সপ্রেস’। সেই থেকে ঐ রেলপথে শুধু রাজশাহী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত একটি ট্রেনই চলছে। করোনাকালে ট্রেনটি ছয় মাসের জন্য বন্ধ রাখায় রেলপথটি অব্যবহৃত ছিল।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেললাইনটি চালু করতে নতুন ১০টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়। লেভেলক্রসিং হয়েছে ৬০টি। সঙ্গে ছোট-বড় ৯১টি সেতুও নির্মাণ করতে হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব অনিয়মের চিত্র। পরিবহন অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায়ও অনিয়ম ধরা পড়ে। সেই অডিট আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি করা হয়নি।

পাবনার সাদুল্লাপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম মোল্লা জানান, এখন এই রেললাইনের তেমন উপকার পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু পাবনার চার উপজেলার মানুষ একটি ট্রেনে রাজশাহী যাওয়া-আসা করছে।

স্থানীয়রা জানান, রেলপথের ১০টি স্টেশনের মধ্যে বাঁধের হাট, কাশিনাথপুর, সাঁথিয়া, রাজাপুর, তাঁতিবন্ধ, দুবলিয়া ও রাঘবপুর স্টেশনে রেলওয়ের নিজস্ব কোনো লোকবল নেই। চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী জনবল দিয়ে স্টেশনগুলো চালানো হয়। এসব স্টেশনে নিরাপত্তাকর্মীও থাকেন না। ফলে স্টেশনে থাকে বখাটেদের উৎপাত। বসে মাদকের আড্ডা।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই রেলপথ দিয়ে একটি ট্রেনে মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হয়। গত মার্চের হিসাব অনুযায়ী, ঢালারচর এক্সপ্রেস ৪৭ হাজার ৬৯৫ জন যাত্রী পরিবহন করেছে। তাদের কাছে ৩৫ লাখ সাত হাজার ৬২ টাকার টিকিট বিক্রি করা হয়। কিন্তু ট্রেনটির পরিচালনাসহ স্টেশন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে ব্যয় এর চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।

বিপুল টাকা লোকসান করে রেলপথটিতে মাত্র একটি ট্রেন চালানোর সমালোচনা করেছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান রিপন। 

তিনি বলেন, এ ধরনের প্রকল্প আসলেই দুর্ভাগ্যজনক। প্রতিটা প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এর কস্ট অ্যাফেক্টিভ অ্যানালাইসিস করা দরকার। কত খরচ করলে রিটার্ন কত আসবে, সেটা হিসাব করতে হবে। রিটার্ন আনার পরিকল্পনা থাকতে হবে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার জানান, এই রেলপথে আরো ট্রেন প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সামর্থ্যই নেই নতুন ট্রেন চালানোর। তবে আমাদের ইচ্ছে আছে এ রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর।