কর ফাঁকি থেকে রোগীর গলা কাটা, সব অপকর্মেই ইউনাইটেডের নাম

হাসপাতাল মানেই মহান চিকিৎসা সেবা ও মানবিকতার প্রতীক। গুরুতর অসুস্থ হলে কিংবা জীবন রক্ষার জন্য সবাই দৌড়ান হাসপাতালে। কিন্তু রাজধানীর গুলশানের অভিজাত ‘ইউনাইটেড হাসপাতাল’ দীর্ঘদিন ধরেই চলছে উল্টোপথে। আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসার কথা বলা হলেও ছোটোখাটো ক্লিনিকের মতো এই হাসপাতালের সেবা। শুধু তাই নয়, এখানে কেউ ভর্তি হলে বাড়তি বিল ধরিয়ে রোগীর গলাকাটা হয়। শুধু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নয়, প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

অভিযোগ আছে প্রয়োজন না থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নানা ফন্দিতে রোগীদের দীর্ঘদিন ভর্তি রেখে মোটা অঙ্কের বিল আদায় করে। যে অপারেশনের প্রয়োজনই নেই, অতিরিক্ত টাকা আদায়ে সেটি করাতে কৌশলে রোগীকে বাধ্য করা হয়। নানা ধরনের পরীক্ষা ও সেবার নামেও রোগী-স্বজনদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় বাড়তি ভুতুড়ে বিল। ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এখন হরহামেশাই পাওয়া যায়।

এখানেই শেষ নয়, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলায় রোগী মৃত্যুর মতো বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগও আছে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এমনকি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর লাশ আটকে রেখে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের নজির রয়েছে এ হাসপাতালে। এমন ভুড়িভুড়ি অভিযোগের পরেও ভ্রুক্ষেপ নেই কর্তৃপক্ষের; কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।

‘পাঁচতারকা’ মানের হাসপাতাল হওয়ায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও ইউনাইটেড হাসপাতালের অভিযোগ তদন্তে কার্যত কোনো ভূমিকা রাখছে না, একেবারে নীরব তারা।

গেল বছরের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা অবহেলায় গালফ এয়ারের পাইলট ইউসুফ হাসান আল হিন্দির মৃত্যু হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছিলেন তার বোন তালা এলহেন্ডি জোসেফিনো। একই সঙ্গে তিনি হাসপাতালটির লাইসেন্স বাতিল ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে তালা এলহেন্ডি বলেন, ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে ইউসুফ হাসান আল হিন্দি ঢাকার মেরিডিয়ান হোটেলে ছিলেন। পৌনে ৩টার দিকে তিনি ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হয়ে যান। ভোর ৪টার দিকে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্নের সময় অসুস্থ হলে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নেয়া হয়। সেখানে তিনি পরপর চার বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হন। এরপর বেলা ১২টার দিকে মারা যান ইউসুফ হাসান।

হাসপাতালে নেয়ার পর থেকে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো কার্ডিওলজিস্ট তার ভাইকে চিকিৎসা দেননি বলেও অভিযোগ তোলেন তালা এলহেন্ডি। তিনি বলেন, কার্ডিওলজিস্ট ছাড়া পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়া শেষ করে চিকিৎসার অবহেলা করা হয়েছে।

তালা এলহেন্ডি আরও বলেন, পুরো ৮ ঘণ্টা হাসপাতালে থাকলেও ইউসুফ হাসান আল হিন্দির সুচিকিৎসায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি যে চিকিৎসক চিকিৎসা দিয়েছেন, তার নামও ব্যবস্থাপত্রে নেই।

তবে সংবাদ সম্মেলনে পাইলট ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ইউসুফ হাসান আল হিন্দির বোন তালা এলহেন্ডির জোসেফিনোর দাবিকে মনগড়া ও মিথ্যা উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সাড়ে ২১ কোটি টাকা কর ফাঁকি

২০১৮ সালে প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছিল রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে। ওই বছরের জানুয়ারিতে দুদকের উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে গুলশান থানায় এ মামলা করেন। মামলায় ইউনাইটেড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রহমান খান ছাড়াও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার রহিমা বেগমকে আসামি করা হয়। পরে ঢাকা মহানগর আদালত থেকে জামিন নিয়েছিলেন ফরিদুর রহমান খান।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০০৬ সালে রাজধানীর গুলশান-২ আবাসিক এলাকার ৭১ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর বাড়ির বেইজমেন্টসহ একটি আটতলা ভবনে কার্যক্রম শুরু করা ‘কন্টিনেন্টাল হাসপাতাল’। পরের বছর মালিকানা ও নাম বদলে ‘ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেড’ হয়। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনের তালিকায় এখনও আগের নামই বহাল রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শামসুদ্দিন হাওলাদার (৯০) নামে একজন প্রবীণ নাগরিক অসুস্থ হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সে সময় তাকে এমআরআই করার জন্য চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে স্বজনরা সে পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তখন ইউনাইটেড হাসপাতালে এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকার কথা বলে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা রোগীকে পার্শ্ববর্তী জয়নুল হক সিকদার মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।

সেখানে এমআরআই পরীক্ষার পর বিল করা হয় ১৪ হাজার টাকা। কিন্তু সেই বিল কৌশলে নিজেদের হাতে নিয়ে নেন ইউনাইটেড হাসপাতালের কর্মীরা। অথচ রোগীর ছাড়পত্র দেওয়ার দিনে এমআরআইয়ের সেই ১৪ হাজার টাকার বিলের সঙ্গে আরও ৯ হাজার টাকা বাড়িয়ে রোগীকে ২৩ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেয় ইউনাইটেড হাসপাতাল। এ বিষয়ে ওই রোগীর ছেলে মোহসিন আহমেদ প্রতিবাদ করলে তখনকার ডিউটি কর্মকর্তারা সাফ জানিয়ে দেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলে লাভ হবে না। এটাই ইউনাইটেড হাসপাতালের এমআরআইয়ের খরচ।’

২০১৬ সালে এ ঘটনায় ইউনাইটেড হাসপাতালে ভুতুড়ে বিল নিয়ে তখন একাধিক গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশ হয়েছিল। এ ছাড়াও ২০২০ সালের ২৭ মে করোনা মহামারির সময় ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ রোগীর করুণ মৃত্যু হয়। এতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগে মামলা হলে হাসপাতালটির চেয়ারম্যান-এমডিসহ শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশ। পরে মামলাটি উচ্চ আদালত হয়ে আপিল বিভাগে গেলে আদালতের নির্দেশে নিহত চারজনের পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা করে দিতে হয় হাসপাতালটিকে। আর মনিরুজ্জামান নামে মৃত অপরজনের পরিবারের সঙ্গে আদালতের বাইরেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সুরাহা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া ২০১৪ সালের ১৬ আগস্ট গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসা খরচের টাকা না দেওয়ায় এক ব্যক্তির লাশ আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। রাজধানীর মগবাজারের দিলু রোডের বাসিন্দা মো. আসলাম হোসেন (৫৪) প্রায় দেড় মাস ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান। তার চিকিৎসা খরচ বাবদ ৩১ লাখ টাকার মধ্যে ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেন তার পরিবারের সদস্যরা। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ হস্তান্তর করছে না বলে অভিযোগ করেছিলেন আসলামের মেয়ে সাদিয়া ইসলাম। বিষয়টি থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

১৫ বছর আগে ২০০৮ সালে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক মান্নার মৃত্যুর পর ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে ‘ভুল’ চিকিৎসার অভিযোগ উঠেছিল। বুকে ব্যথা নিয়ে চিত্রনায়ক মান্না ওই হাসপাতালে ভর্তি হলে কয়েক ঘণ্টা পর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মান্নার শ্যালক রেজা কাদের তখন মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় হাসপাতালের ছয় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বিচারও শুরু হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালত মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন।

ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ও অবহেলার বিষয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে দেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এম এনামুল হকের চিকিৎসাসেবা নিয়ে। দেশের স্বনামধন্য এ ব্যবসায়ীও অসুস্থ হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে সীমাহীন বিড়ম্বনা ও অবহেলার শিকার হয়েছেন। পরে তার চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়ে গুলশান থানায় জিডি করা হয়।