লিটন আর দুর্নীতি যেন একই সূত্রে গাঁথা

ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

নগরীর দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতিগুলোকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের অন্যতম বড় অর্জন বলে প্রচার করা হয়েছে। এটি সত্য যে সড়কবাতিগুলো নগরীর সৌন্দর্য বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। শুধু নগরবাসীই নয়, বাইরের এলাকা থেকেও অনেকে এসে এই সড়কে ছবি তুলেছেন। সারা দেশেই প্রশংসিত হয়েছে রাসিকের এই উদ্যোগ। তবে সড়কবাতি কেনায় গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

সড়কবাতির স্থাপনে নিয়োজিত ঠিকাদারের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি যে শুধু সড়কবাতি কেনার ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়। রাজশাহীর সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে পরিচিত লিটন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের সব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দরপত্র নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জমি দখল ও পুকুর ভরাট তো রয়েছেই।

দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নিজের ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের স্বার্থ রক্ষায় একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন লিটন। এসব প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার জমি দখল করে নেন। লিটন ও তার ব্যবসায়িক অংশীদাররা জমি দখল করার পাশাপাশি নামমাত্র মূল্যে বিতর্কিত জমি কিনে থাকেন। দ্য মিরর এশিয়ার কাছে এ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ নথি রয়েছে।

প্রদীপের নিচে অন্ধকার

রাসিকের প্রকৌশল বিভাগ থেকে পাওয়া নথিতে দেখা যায়, নগরীর মোট ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪টি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও ১৬টি ফ্লাডলাইট স্থাপনে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৫৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ, প্রতি কিলোমিটার সড়কবাতির পেছনে খরচ করেছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৫১ হাজার ৮০০ টাকা। আর ১৬টি হাইরাইজ ফ্লাডলাইট স্থাপনে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

২০২০ সালের অক্টোবরে এ নিয়ে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির একটি দল রাজশাহীর নগর ভবনে অভিযান চালিয়ে এ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করে। দুদকের প্রাথমিক তদন্তে এ কাজে দুর্নীতির প্রমাণও পাওয়া গেছে। তারপর রহস্যজনকভাবে দুদকের তৎপরতা সেখানেই থেমে যায়। বরং অভিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে আরও কিছু সড়কে আলোকসজ্জার কাজ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে দুদকের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।’ তবে তদন্তে কী পাওয়া গেছে তা বলতে রাজি হননি তিনি।

তবে দুদক সূত্র দ্য মিরর এশিয়াকে বলেছে, এ প্রকল্পে গুরুতর অনিয়ম পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগ নেতা লিটন প্রভাব খাটিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া বন্ধ করতে চাপ দেন। এরপরই মূলত ফাইলটি ধামাচাপা পড়ে যায়। ওই ঠিকাদার লিটন পরিবারের একজন অনানুষ্ঠানিক ব্যবসায়িক অংশীদার বলেও দাবি করেছে ওই সূত্র।

আরও পড়ুন: এক বছরেই ছয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা 

আরও পড়ুন:  ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়র লিটনের রহস্যময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক

রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে হাই ভোল্টেজ এলইডি যুক্ত ১৬টি ফ্লাডলাইট বসানোর জন্য ৯ কোটি ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬০ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। সে বছরের ৭ সেপ্টেম্বর হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান ৯ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৭ টাকার দরপত্র জমা দেয়। আর কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা না দিলেও পুনঃদরপত্র ছাড়াই হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এরপর ‘ভুক্তভোগী ঠিকাদার’ পরিচয়ে এ কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে মন্ত্রণালয় ও দুদকে চিঠি দেওয়া হয়।

ওই চিঠিতে বলা হয়, টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঁচ বছর কাজের অভিজ্ঞতা নেই। এর পরেও রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) লঙ্ঘন করে হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে কার্যাদেশ প্রদান করে। বিল প্রদানের ক্ষেত্রেও গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের জন্য চালানের নথি, এলসি, বিল অব ল্যান্ডিং, শুল্ক, ট্যাক্স এবং ভ্যাট প্রদান সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র জমা না দিলেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এখানে এমনভাবে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল যাতে করে শুধুমাত্র হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিং-ই কাজ পায়। আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অনুযায়ী পুরো প্যাকেজের মোট মূল্য ২ কোটি ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৭৩৪ টাকা। তবে দরপত্র আহ্বান করা হয় ৯ কোটি ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬০ টাকার; যা প্রতিটি জিনিসের তিনগুণ থেকে চারগুণ বেশি। পরিকল্পিতভাবে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার ড্রপের সুযোগ দিয়ে পুরো কাজটি হ্যারোকে দেওয়া হয়।

চীনে তৈরি ২০ থেকে ২৫ মিটার উঁচু মাস্ট পোলের সর্বোচ্চ দাম ৩ হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৬১ হাজার টাকা। এর পাশাপাশি ৬১ শতাংশ আমদানি শুল্ক ধরলে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২১০ টাকা, ক্রয়মূল্যের ২০ শতাংশ হিসেবে ভ্যাট ও আয়কর ৪৩ হাজার ২০০ টাকা, বন্দর থেকে দেশের যে কোনো স্থানে সর্বোচ্চ পরিবহন ও ইনস্টলেশন খরচ ৭০ হাজার টাকা এবং প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ১৫ শতাংশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা যোগ করলে প্রতিটি পোল বা ফ্লাডলাইটের দাম হয় সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭২ হাজার ৫১৫ টাকা। অথচ, রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিটি পোলের জন্য হ্যারোকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিটি পোলের জন্য অতিরিক্ত বিল দেওয়া হয়েছে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৫ টাকা।

ফ্লাডলাইটে ব্যবহৃত ২০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩২০টি এলইডি বাল্বের বাজারমূল্য ১৫ হাজার ৮৭৩ টাকা হলেও দরপত্রে দাম উল্লেখ করা হয়েছে ২ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এখানে প্রতিটি ২০০ ওয়াটের এলইডির দাম ৬৩ হাজার ৮০০ টাকা ধরে মোট ২ কোটি ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। তবে বাজারে ৩২০টি এলইডির দাম সর্বোচ্চ ৫০ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬০ টাকা। এক্ষেত্রে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত ১ কোটি ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৪০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ফ্লাডলাইটে যুক্ত করা ২০০/২৫০ ওয়াটের এলইডির প্রতিটির বাজারমূল্য ১৯ হাজার ৩০৯ টাকা হলেও দরপত্রে প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা এবং মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চাইনিজ আরওএইচএস (RoHS) কোম্পানির তৈরি ২০০টি এলইডির মোট বাজারমূল্য আসে ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৮০৪ টাকা। তবে এজন্য হ্যারোকে পরিশোধ করা মোট বিল ১ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা; এখানে অতিরিক্ত ১ কোটি ১১ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ৬৩টি এএমপি অটো লজিক কন্ট্রোলারের একটি ইউনিটের বাজারমূল্য ৩৬ হাজার টাকা হলেও ১৬টি এএমপি কন্ট্রোলারের প্রতিটি ইউনিটের মূল্য ৭২ হাজার টাকা ধরে ঠিকাদারকে ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকা বিল দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে হ্যারোকে অতিরিক্ত ৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। একইভাবে ১ হাজার ২৪০ মিটার ক্যাবল সরবরাহের জন্য ঠিকাদারকে ৩৭ হাজার ২০০ টাকার বেশি বিল দিয়েছে রাসিক।

ব্যবসা-রাজনীতি-দুর্নীতি

২০১৩-১৩ থেকে ২০১০-২১ পর্যন্ত এই আট অর্থবছরে শুধুমাত্র রাজশাহীতে একজন ঠিকাদার রাসিক থেকে প্রায় ২৬০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়েছেন। এ সময়ে রাজশাহীতে সব সরকারি সংস্থা মিলিয়ে ৪৩১ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। অর্থাৎ মোট কাজের অন্তত ৬০ শতাংশই পেয়েছে একটি নির্দিষ্ট ঠিকাদার। সুবিধাভোগী ওই প্রতিষ্ঠানটির নাম রিথিন এন্টারপ্রাইজ; যার মালিক হলেন তুরেদ আল মাসুদ রনি। তিনি রাসিক মেয়র ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন: এক বছরেই ছয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা 

আরও পড়ুন:  ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়র লিটনের রহস্যময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহীর একাধিক ঠিকাদার জানান, খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র হওয়ার পর নগর ভবনের টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন রনি। তার অনুমতি ছাড়া সেখানে কাজ করার সুযোগ নেই। রনির কোম্পানি বৈদ্যুতিক কাজ ব্যতীত অন্যসব কাজেই অংশগ্রহণ করে। ব্যবসায়িক সম্পর্ক ঠিক রাখতে সম্প্রতি লিটন রনিকে ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠন নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে বসান।

দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮ সালে যখন লিটন প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন তখনই মূলত তুরেদ আল মাসুদ রনির সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। ২০১৩ সালে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আগেই ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ২০ কোটি টাকার টেন্ডার চূড়ান্ত করে রাখেন লিটন। যার সবগুলোই রিথিন এন্টারপ্রাইজেসকে দেওয়া হয়। রাসিক মেয়রের পদ হারানোর পরের অর্থবছরে রিথিন এন্টারপ্রাইজের মূল্য প্রায় ৯ কোটিতে নেমে আসে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা আরও কমে প্রায় আড়াই কোটিতে নেমে যায়। যার পরের বছরে সিটি কর্পোরেশন থেকে কোনো কাজই পায়নি রিথিন এন্টারপ্রাইজ। 

২০১৮-১৯ অর্থবছরের শুরুতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবারও মেয়র পদে প্রত্যাবর্তন করেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তখন যেন হঠাৎই আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান রনি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিথিন এন্টারপ্রাইজ রাসিক থেকে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা পায়। যা পরের অর্থবছরে হয়ে যায় ১৪ গুণ। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের রাসিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে লিটন রনিকে রাজশাহীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বানিয়েছেন।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিথিন এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া কাজের মোট মূল্য ছিল ১০১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৬ হাজার ৮০৩ টাকা। এর মধ্যে রাসিকের কাজ হয়েছে ৫৫ কোটি ২৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৪ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি মোট ৮৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার ৭৩৫ টাকা কাজ করেছে। এর মধ্যে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের কাজ ছিল ৫৯ কোটি ৯৯ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩০ টাকার। ২০২০-২১ অর্থবছরে কাজের পরিমাণ বেড়ে হয় দ্বিগুণ। ওই অর্থবছরে রিথিন এন্টারপ্রাইজ মোট ১৭৪ কোটি ৮০ লাখ ৮৬ হাজার ১২২ টাকার কাজ করে। এর মধ্যে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের কাজই ছিল ১০৬ কোটি ৮৮ লাখ ৫১ হাজার ৫৭৪ টাকা।

বিলের রশিদ ও কর্মসম্পাদনের সনদসহ বিভিন্ন নথি ঘেঁটে দেখা যায়, এই আটটি অর্থবছরে রিথিন এন্টারপ্রাইজ রাসিকের ২৫৯ কোটি ৬৮ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৭ টাকার উন্নয়ন কাজ করেছে। যার মধ্যে তারা ২৪২ কোটি ৩৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২৮ টাকার কাজ পেয়েছেন- যখন রাসিকের মেয়রের চেয়ারে ছিলেন লিটন।

স্থানীয় ঠিকাদাররা জানান, তুরেদ আল মাসুদ রনি শুধু রাসিকেই থেমে থাকেননি। খায়রুজ্জামান লিটন ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে রাজশাহী ও এর বাইরে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাজ পান তিনি। রনি রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ), ওয়াসা, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (রুয়েট) বেশিরভাগ স্থানীয় কাজের টেন্ডার পেয়েছেন।

রিথিন এন্টারপ্রাইজ থেকে পাওয়া নথি বিশ্লেষণ করেও এমনটিই জানা গেছে। লিটন মেয়র হওয়ার আগে রাসিকের বাইরে রনির কাজের পরিমাণ ছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ কোটি ৭১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮০ টাকা, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৮ কোটি ৫৮ ​​লাখ ৬৬ হাজার ৫১৮ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ ২২ হাজার ২০৭ টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে তাদের প্রাপ্ত কাজের মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ কোটি ১৬ লাখ ১৮ হাজার ৮২৯ টাকায়। পরের বছরে এর পরিমাণ ছিল ২৩ কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার ১০৫ টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে রিথিন এন্টারপ্রাইজ রাসিক ছাড়া অন্যান্য সরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠানে ৬৭ কোটি ৯২ লাখ ৩৪ হাজার ৫৪৮ টাকার কার্যাদেশ পায়।

লিটনের সাম্রাজ্যে দুর্নীতিই চাবিকাঠি

২০২০ সালে ফ্লাডলাইট বিতর্কের পর হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিং রাজশাহী শহর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংযোগকারী বিলসিমলা রেল ক্রসিং থেকে কাশিয়াডাঙ্গা পর্যন্ত ৪.২ কিলোমিটার সড়ক বিভাজকের ওপর দর্শনীয় আধুনিক সড়কবাতি (বাটারফ্লাই লাইট) স্থাপনের কার্যাদেশ পায়। ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন মেয়র লিটন। তবে দেড় মাস না যেতেই সে বছরের ৪ এপ্রিল ঝড়ে এসব সড়কবাতি নষ্ট হয়ে যায়। পরে সব বাতি ও খুঁটি অপসারণ করা হয়। এরপরও রাজশাহী নগরীতে সড়কবাতির কাজ পেয়েছে হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিং।

বিলসিমলা-কাশিয়াডাঙ্গাসহ রাজশাহীর পৃথক ৪টি সড়কের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব রাস্তায় সড়কবাতির জন্য ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৫৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ, প্রতি কিলোমিটার সড়কে আলোকসজ্জায় রাসিকের ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৫১ হাজার ৮০০ টাকা। বিলসিমলা-কাশিয়াডাঙ্গা ৪.২ কিলোমিটার সড়কে প্রতি কিলোমিটারে এই ব্যয় ১ কোটি ২৪ লাখ ২৮ হাজার ৫৭১ টাকা। এ সড়কে খুঁটিসহ ১৭৪ সেট সড়কবাতি রয়েছে। প্রতিটি সেটে দুটি এলইডি বাতি রয়েছে। সে অনুযায়ী সেটপ্রতি খরচ হয়েছে ৩ লাখ টাকা। এই চারটি রাস্তার মধ্যে এই সড়কে সেটপ্রতি খরচ সবচেয়ে বেশি।

২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর নগরীর আলিফ লাম মীম ভাটা থেকে নাদের হাজি মোড় পর্যন্ত বিমান সড়ক খ্যাত আড়াই কিলোমিটার সড়কে খুঁটিসহ ৮৭টি ‘রোড ল্যাম্প’ সেটের উদ্বোধন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ সড়কের প্রতি কিলোমিটারে ৯০ লাখ টাকা এবং সেটপ্রতি দুই লাখ ৫৮ হাজার ৬২০ টাকা ব্যয় হয়েছে। এই সড়কের বাকি অংশ নাদের হাজী মোড় থেকে বিহাস পর্যন্ত ৪.৭ কিলোমিটারে খুঁটিসহ ১৯৮ সেট সড়কবাতি বসানো হয়। এতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। প্রতি সেট সড়কবাতির দাম পড়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৬২ টাকা।

রাজশাহীতে রয়্যাল ক্রাউনের আদলে সবচেয়ে প্রশংসিত হয়েছে সড়কের ঊর্ধ্বমুখী বাতিগুলো। যেগুলো প্রাথমিকভাবে তালাইমারি পর্যন্ত রাস্তায় স্থাপন করা হয়েছিল। দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কে আলোকসজ্জায় ব্যয় হয়েছে তিন কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সড়কের ডিভাইডারে ১৩০টি খুঁটির প্রতিটিতে ১৩টি করে বাতি রয়েছে। প্রতিটি খুঁটির মধ্যে দূরত্ব মাত্র ১১.৫ মিটার। এছাড়া সড়ক সংলগ্ন বেড়িবাঁধে রয়েছে ১৮০টি গার্ডেন লাইট সেট। এ সড়কে প্রতি কিলোমিটারে আলোকসজ্জায় ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। গার্ডেন লাইটসহ প্রতিটি সড়কবাতিতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৮ টাকা।

আরও পড়ুন: এক বছরেই ছয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা 

আরও পড়ুন:  ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়র লিটনের রহস্যময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক

অন্যদিকে, ২০১৭ সালে ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তায় রিথিন এন্টারপ্রাইজ রাজশাহী মহানগরীর সপুরা এলাকায় মঠ ও পুকুর সংস্কারের একটি প্রকল্পের কাজ পায়। এ কাজ শুরুর পরপরই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিম্নমানের কাজের অভিযোগ ওঠে। এক পর্যায়ে পুকুরটির সুরক্ষা দেয়ালের একটি অংশ নির্মাণের কয়েক দিনের মধ্যেই ধসে পড়ে। সে সময় ভারত সরকার কাজের মান বজায় রাখার জন্য রাসিককে অনুরোধ করে।

একই বছর রাজশাহীর ঐতিহাসিক মিয়ানপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি ভেঙে রফিক কনস্ট্রাকশন, রিথিন এন্টারপ্রাইজ ও মিম কনস্ট্রাকশনের যৌথ উদ্যোগে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। কাজটি করতে ভারত সরকার আর্থিক সহায়তা দেয়। ওই সময় পুরোনো ভবন ভেঙে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়। তবে পুরো কাজের আগে শুধু পাইলিংয়েই পুরো বরাদ্দ খরচ করে ফেলে ঠিকাদার। ফলে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, যা সম্প্রতি নতুন করে টেন্ডার দিয়ে পুনরায় শুরু হয়েছে।

ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে লিটন ২০১৮ সালে মেয়রের চেয়ারে বসার পর নতুন করে রিথিন এন্টারপ্রাইজকে কাজ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি রাসিক রিথিন এন্টারপ্রাইজকে একটি সার্টিফিকেট অব এক্সিকিউশন দেয়। এতে বলা হয়, অসমাপ্ত পাবলিক লাইব্রেরির সমস্ত কাজ ছিল সম্পন্ন করা হয়েছিল।

এসব বিষয়ে জানতে রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও আশরাফুল হুদা টিটুর সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে রিথিন এন্টারপ্রাইজের তুরেদ আল মাসুদ রনি দাবি করেছেন, নিয়ম অনুযায়ী ও যোগ্যতার কারণেই তার প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়ে এসেছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি।

তার উল্টো অভিযোগ, যারা তাকে ও খায়রুজ্জামান লিটনের পরিবারকে নষ্ট করতে চায় তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব তথ্য ছড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন: এক বছরেই ছয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা 

আরও পড়ুন:  ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়র লিটনের রহস্যময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক