পরিচালক ফানাফিল্যার শত কোটির বাড়ি, উপ-পরিচালক আবু বকরের সিন্ডিকেট বাণিজ্য

বাঁ দিক থেকে আবু বকর ও শেখ মোহাম্মদ ফানাফিল্যা/ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ফানাফিল্যার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ নেওয়ার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত চার বছর ধরে দুদকের অভ্যন্তরীণ বিশেষ গোয়েন্দা দল তদন্ত চালায়। তদন্তে বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়। তবে অদৃশ্য কারণে সেই তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেছে। প্রতাপশালী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি দুদক।

অভ্যন্তরীণ বিশেষ তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দ্য মিরর এশিয়াকে জানান, শেখ মোহাম্মদ ফানাফিল্যার অনিয়ম তদন্তে তারা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বেশ কিছু সম্পদের খোঁজ পেয়েছেন। এর মধ্যে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ৪৮ নম্বর সড়কে ৮ নম্বর বাড়িটি তার। জমিসহ বিলাসবহুল এই ডুপ্লেক্স ভবনের মূল্য অন্তত শত কোটি টাকা। এছাড়াও বেশ কিছু মামলার তদন্তে অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগসাজশে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগেরও সত্যতা পাওয়া গেছে। এর বাইরে পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামেও বহু স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত দল। কিন্তু গোপন ইশারায় থেমে গেছে দুদকের এই পরিচালকের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের দিন ‘অনৈতিক সুবিধা দিয়ে’ চাকরির শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করার অভিযোগে ফানাফিল্যার বিরুদ্ধে দুদক বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছিল ২০২০ সালে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিনকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।

রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ আসে- তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করে চট্টগ্রাম বন্দরে একচেটিয়া বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচার করছেন।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে এই অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর রুহুল আমিনকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছিল।

দুদক সূত্র জানায়, ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টায় তরফদার মো. রুহুল আমিন দুদকে হাজির হলে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে পরিচালক শেখ ফানাফিল্যা তার কক্ষে নিয়ে যান।

দুদকের এক নথিতে বলা হয়েছে, কমিশনে নির্ধারিত জিজ্ঞাসাবাদের কক্ষ থাকা সত্ত্বেও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তার (ফানাফিল্যা) অফিস কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেন, যদিও তিনি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে জড়িত নন।

বিষয়টি অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানালে নির্ধারিত জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

এরপর রুহুল আমিনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ না হলেও অভিযোগ তাকে সাথে করে নিয়ে আবার নিজের অফিস কক্ষে চলে যান ফানাফিল্যা।

দুদকের ভেতরেই দুর্নীতিবাজ পর্ব-১: দুর্নীতি করে অঢেল সম্পদের মালিক উপ-পরিচালক মাহাবুব

অনুসন্ধান কর্মকর্তা মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন লিখিতভাবে কমিশনকে বিষয়টি জানালে ফানাফিল্যাকে কারণ দর্শনার নোটিশ দেওয়া হয়। ফানাফিল্যা লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি কমিশন। তার বিরুদ্ধে ‘দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ এবং চাকরি শৃঙ্খলা পরিপন্থীর’ অভিযোগে গত ওই বছরের ১৩ অক্টোবর কমিশন সভায় বিভাগীয় তদন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।

ফানাফিল্যা দাবি করেছিলেন, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জিজ্ঞাসাবাদের দিন ‘অসুস্থ’ ছিলেন। যে কারণে ‘মানবিক দিক বিবেচনা করে’ সহায়তা করেছিলেন তিনি।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ফানাফিল্যার বিরুদ্ধে ওঠা ওই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিশনের তৎকালীন মহাপরিচালক মো. জাকির হোসেনকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। আর তার তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই সময়ের দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতকে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ফানাফিল্যাকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

অন্যদিকে, অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা উপ-পরিচালক আবু বকরের বিরুদ্ধেও রয়েছে বহু অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে দুদকের অভ্যন্তরীণ এবং গোয়েন্দা ইউনিট। এরই মধ্যে অধিকাংশ অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র দ্য মিরর এশিয়াকে জানিয়েছে, উপ-পরিচালক আবু বকরের নামে-বেনামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বেশ কিছু সম্পদের তথ্য পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে, ঢাকার মুগদায় একটি সাততলা বাড়ি, গুলশানে কয়েক কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাট, উত্তরায় জমি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে অভ্যন্তরীণ তদন্ত দল।

অভিযোগ রয়েছে, আবু বকর দায়িত্বে থাকাকালে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দায়মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে দফায় দফায় টাকা আদায় করতেন। পাশাপাশি অনুসন্ধান বা তদন্তাধীন মামলা কিংবা অভিযোগে অভিযুক্তদের সঙ্গে নিজের অন্য সহকর্মীদের মধ্যে আপোষ-মীমাংসার মধ্যস্ততাও করেছেন আবু বকর। এসবের মাধ্যমে হাতিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।

উপ-পরিচালক আবু বকর তার কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনের সমন্বয়ে গড়েছেন আরেকটি সিন্ডিকেট। যাদের লক্ষ্য অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করা, ঘুষের পরিমাণ নিয়ে দর কষাকষি ও অবৈধ অর্থ গ্রহণ।

এমনকি, এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে দুদকের নামে ভুয়া নোটিশ পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা আদায় করেছেন আবু বকর। তার এই অনিয়ম-দুর্নীতির সিন্ডিকেট দুদকে ‘ওপেন সিক্রেট’।

তবে অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা দুদকের উপ-পরিচালক আবু বকরের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে বারবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্টীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা যদি আসলেই এমন হয়- তা অবশ্যই ভয়ের। কারণ, যাদের দুর্নীতি-অনিয়ম রোধে ভূমিকা রাখার কথা তাদের নামে এসব অভিযোগ! আসলে সেগুলো গুরুত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিৎ। অন্যথায়, এর দায় কর্তৃপক্ষের ঘাড়েই বর্তায় বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানান, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলছে। তদন্ত থেমে গেছে কি-না সেটিও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমলযোগ্য অপরাধ করে কারো পার পাওয়ার সুযোগ নেই।’

আরও পড়ুন: দুদকের ভেতরেই দুর্নীতিবাজ পর্ব-১: দুর্নীতি করে অঢেল সম্পদের মালিক উপ-পরিচালক মাহাবুব