দিলু রোডের মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ফেসবুকে হইচই

ঘটনার সূত্রপাত একটি ফেসবুক পোস্ট নিয়ে। গত ১ জুলাই ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’ ফেসবুক গ্রুপে একটি পুরোনো ছবি পোস্ট করেন এক নারী। তার নাম সায়মা খান। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে যে ছবিটি তিনি পোস্ট করেছেন সেটি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ট্রেনিং চলাকালে তোলা বলে দাবি করেন। ছবিতে এক তরুণীকে রাইফেল হাতে দেখা গেছে।

সায়মা খান নামে ওই নারী ছবিটির ক্যাপশন দিয়েছেন এমন- ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি সায়মা খান। ১\৩ দিলুরোডে ট্রেনিংয়ের সময়। বীর মুক্তিযোদ্ধা সায়মা খান।’

তার এই পোস্টের পরই শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। দুদিন পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড়। তার সেই পোস্টের নিচে হাজার হাজার মন্তব্য জমা পড়েছে। যাদের মধ্যে সায়মা খানের প্রশংসা করছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার ছবিতে ‘অসঙ্গতি’ রয়েছে উল্লেখ করে সমালোচনা করছেন। অনেকে নিজের টাইমলাইনে পোস্ট দিচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ বলছেন, ছবিটি বাস্তবসম্মত নয়। কেউ আবার সায়মা খানের পক্ষও নিচ্ছেন।

সবমিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘দিলু রোড’ এখন ‘মোস্ট পপুলার’। অনেকে কৌতুহলী হয়ে জানতে চাচ্ছেন, ‘দিলু রোড নিয়ে হয়েছেটা কী?’

ছবিটি শেয়ার করে অবাহাওয়াবিদ ও রাজনীতিক একেএম ওয়াহিদুজ্জামান লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় দিলু রোডে নাকি এই মহিলা ট্রেইনিং নিয়েছে! তাও আবার এই একে-৫৬ চাইনিজ রাইফেল দিয়ে! মিথ্যা বলার একটা লিমিট থাকে, এই মহিলা সব সীমা পার করে ফেলেছে।’

তার যুক্তি, ‘মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় চাইনিজ রাইফেল (যেটা ওই নারী কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছেন) ব্যবহার করতো কেবলমাত্র পাকিস্তান আর্মি। ইপিআর, পুলিশের সবাই এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু ইউনিট ব্যবহার করত লি এন্ড ফিল্ড ৩০৩ রাইফেল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় পুলিশ-ইপিআরের বেশি সংখ্যক সদস্য তাদের ৩০৩ রাইফেল নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহীদের কাছেও এই অস্ত্র ছিল। ফলে একই গুলি ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসল্ট রাইফেল হিসেবে যুদ্ধের সময় ৩০৩ ব্যবহার করেছে। একই কারণে ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের যে অস্ত্রগুলো দিয়েছিল সেগুলোও ছিল ৩০৩ রাইফেল। এর বাইরে ভারত দিয়েছিল কিছু 1A1 সেলফ লোডিং রাইফেল, যা এসএলআর নামে পরিচিত ছিল। অটোমেটিক রাইফেল, সাব মেশিনগান হেভি মেশিনগান এবং মর্টারস ছিল অভিজ্ঞ বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা ইপিআর এর ইনফ্যান্ট্রি সৈন্যদের কাছে।’

তিনি এও উল্লেখ করেছেন, ‘সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের কারো কাছেই কখনো অটোমেটিক রাইফেল ছিল না। পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র হাতিয়ে নিয়ে যুদ্ধের পরে ছবি তুলে যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে, তাদেরকে এসব বুজরুগি নিঃসংকোচে ধরিয়ে দিবেন।’

বুদ্ধিজীবী ও অনুবাদক তুহিন খান লিখেছেন, ‘আদর্শ (আদর্শ প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত সালমা সিদ্দিকীর “বীরের বয়ান” বইতে সায়মা খানের একটা ইন্টারভিউ আছে। সেখানে বহুল প্রচারিত দিলু রোডে ট্রেনিংয়ের ছবিটাও আছে। বিভিন্নভাবে খোঁজ-খবর নিয়া যতটুকু বুঝলাম, ছবিটা সায়মা খানেরই। তবে ছবির ন্যারেটিভে কিছুটা ঘাপলা আছে।’

তিনি লিখেছেন, ‘৫ পেজের ইন্টারভিউয়ের সারমর্ম হইল, সায়মা খান কখনও সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন নাই, বা এ ধরনের কোনো ট্রেনিংও নেন নাই। অন্তত ওই ইন্টার্ভিউতে এ ধরনের কোনো আলাপ নাই। যা আছে তা হলো, ভাই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুবাদে তাদের বাসাটা এক ধরনের অস্ত্রগুদামে পরিণত হইছিল। বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র লুকানো থাকত তাদের বাসায়। সম্ভবত সেই দিলু রোডের বাসায়ই কোনো এক অলস দিনে গান কান্ধে নিয়া পোজ দিছিলেন সায়মা খান। এছাড়া ১৪ আগস্ট স্বাধীন বাঙলার পতাকা বানায়ে সার্কুলেট করা, বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেওয়া— এ ধরনের কিছু কাজবাজ উনি করছেন। কিন্তু দিলু রোডে ট্রেনিংয়ের কোনো আলাপ এই ইন্টারভিউতে নাই।’

গেরিলা ১৯৭১ সূত্রের বরাতে আহসান তাপস নামক এক ফেসবুক ব্যবহারকারী বলেছেন, ‘চায়নিজ রাইফেল হাতে মানুষটির নাম সায়মা খান। তিনিসহ তার পুরো পরিবার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই পরিবারের একমাত্র পুত্রসন্তান হাবিবুল আলম বীর প্রতীক একাত্তরে ঢাকার অগ্রগামী গেরিলা দলের সদস্য। ১/৩ দিলু রোডস্থ তাদের পৈত্রিক বাড়ি ব্যবহার হয়েছিল অস্ত্র রাখবার গোপন স্থান হিসেবে। একাত্তরের আগস্টের ২৯/৩০ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই বাড়ি থেকে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করেছিল। ২৫ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে ধানমন্ডি অপারেশনের পর হাবিবুল আলম বীর প্রতীক চলে গিয়েছিলেন মেলাঘরে, ফলে তার পরিণতি অন্য সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মতো হয়নি।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘একাত্তরে হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের ৪ বোনের মাঝে বিবাহিত ছিলেন শ্রদ্ধেয় নাজমা আকবর (১৯ জানুয়ারি ২০১৯ সালে মারা গেছেন), তার স্বামী ছিলেন নেভি অফিসার। তিনিসহ আসমা নিসার, রেশমা আমিন এবং সায়মা খান সকলেই মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ১৪ আগস্ট ১৯৭১, ঢাকার আকাশে শতাধিক বেলুনে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল, এসব পতাকা সেলাই করেছিলেন তারা সকলে। এছাড়া অস্ত্র, গ্রেনেড বহনের মতো কাজও তারা করেছেন। ঢাকার অগ্রগামী গেরিলা দলের বেশ কয়েকজন সদস্য ২৯ ও ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এ সময়ে ১/৩, দিলু রোডের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেবার কিছুদিন পর আসমা নিসার এবং রেশমা আমিন মেলাঘরে চলে যান এবং বাংলাদেশ হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় যুক্ত হন। তবে, শ্রদ্ধেয় সায়মা খান দেশ ছেড়ে যেতে পারেননি, তিনি ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করেন।’

ফেসবুকে বিতর্কের উল্লেখ করে আহসান তাপস আরও বলেন, ‘শ্রদ্ধেয় সায়মা খান সম্প্রতি অস্ত্র হাতে তার যে ছবিটি ফেসবুকের একটি পেজে পোস্ট করে ১/৩ দিলু রোডে প্রশিক্ষণের বিষয়টি জানিয়েছেন; ১/৩, দিলু রোডস্থ বাড়িতে ‘ট্রেনিং এর সময়’ লিখে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তা বোধগম্য নয়। তাদের বাড়িতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি কখনোই, তার বড় ভাই হাবিবুল আলম বীর প্রতীক আজও বেঁচে আছেন, এবং ‘Brave of Heart’ নামে একটি গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। এ বইটিতেও এমন কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। শ্রদ্ধেয় সায়মা খান সন্দেহাতীতভাবেই মুক্তিযুদ্ধের অংশীজন। একাত্তরের সেই ভয়াবহ দিনগুলো আজকের ঝলমলে ২০২৪ সালে অনুধাবন সম্ভব নয়। যে অসীম সাহসে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বহন করেছেন এবং বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তা মোটেও তুচ্ছ নয়। একাত্তরের তার ঠিক যেটুকু ভূমিকা সেটাই গর্বিত হবার জন্য যথেষ্ট মনে করি। এটুকু সাহসও অগণিতজনের ছিল না।’

যেই ছবিটি নিয়ে এতো আলোচনা সেই ছবির নিচে কাউসার শাহীন নামক একজন মন্তব্য করেছেন, ‘দিলু রোডের কোথায় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টার ছিলো জানতে চাই। বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করছি।’

এভাবে অনেকে সায়মা খানকে ছবিটি নিয়ে ওঠা বিতর্ক সম্পর্কে তথ্য দেওয়ারও অনুরোধ করেছেন। তবে এ ধরনের নানা প্রশ্ন তোলা হলেও সায়মা খানের পক্ষ থেকে কোনো জবাব আসেনি।