বিএসএফের গুলিতে নিহতদের শরীরে আঘাতেরও চিহ্ন

ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

গত ৭ মে সন্ধ্যায় ইয়াসিন আলী ও আব্দুল জলিল নামে পঞ্চগড়ের দুই যুবক ভারত সীমান্তে যান। পরদিন সকালেই আসে তাদের মৃত্যুর খবর। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ তাদের গুলি করে মেরেছে বলে খবর এলেও লাশ আসার পর দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। গুলির পাশাপাশি নিহতদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্নও দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যার ঘটনা নতুন নয়। মাঝেমধ্যেই বিএসএফ এমনকি ভারতীয়দের হাতে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তবে সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বিএসএফ শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় না, বাংলাদেশিদের ওপর নানা নির্যাতনও চালায় তারা।

আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। ভারতের এ ধরনের আচরণ বিদ্বেষমূলক।

গত ৮ মে হত্যার শিকার ইয়াসিন আলীর বাড়ি তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট ইউনিয়নের পশ্চিম ব্রহ্মতোল গ্রামে। পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের পূর্বপাশে প্রায় ১ কিলোমিটার এবং মহানন্দা নদী থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার ভেতরের শান্ত নিবিড় গ্রামটিতে এখনো ইয়াসিনের জন্য কেউ কেউ শোকাহত।

গত ২৩ মে দুপুরের পর ইয়াসিনদের বাড়িতে যান দ্য মিরর এশিয়ার এ প্রতিবেদক। ফসলের মাঠের মধ্যে ৫ শতক জমিতে ছোট্ট একটি বাড়ি। ভাঙা-চোরা ঘর। দরজা আছে, বেড়া নেই। বৃষ্টির পানি বাইরে পড়ার আগে ঘরে পড়ে, এমন জরাজীর্ণ অবস্থা।

সেখানে কথা হয় ইয়াসিনের বাবা কিতাব আলীর সঙ্গে। পঞ্চশোর্ধ্ব বর্গাচাষী কিতাব আলীর চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে ইয়াসিন সবার বড়। বসত ভিটা ছাড়া আর কোনো জমি নেই। এর মধ্যে স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন ছোট ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে রয়েছে তার।

কথার ফাঁকে জানালেন সদ্য কৈশর পেরোনো ছেলে ইয়াসিন ছিল বিবাহিত। বাড়িতে তার স্ত্রী রয়েছে। মারা যাওয়ার মাস খানেক আগেই বিয়ে হয় তার। মেয়েটির বাড়ি বরগুনায়।

এরপর ইয়াসিনের স্ত্রী আফরোজা কলিকে ডাকা হয়। কথায় কথায় কলি জানায়, সে বরগুনার স্থানীয় একটি স্কুলে দশ শ্রেণির ছাত্রী। অনলাইনে ইয়াসিনের সঙ্গে কিছুদিন আগে পরিচয়। সেখান থেকে প্রেম। তারপর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি থেকে পালানো, এভাবে পঞ্চগড়ে আসার এক দীর্ঘ কাহিনী।

গত ঈদুল ফিতরের দু’দিন আগে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রুপধন গ্রাম থেকে বাসে করে ঢাকায় আসে কলি। তারপর ট্রেনে করে পঞ্চগড় পৌঁছায়। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা ইয়াসিন আলী তাকে নিয়ে যখন গ্রামের বাড়ি পৌঁছায় রাত তখন প্রায় ৩টা। এরপর ১৮ এপ্রিল তারা পঞ্চগড়ে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে করে।

সেই হিসেবে ইয়াসিন ও কলির ২০ দিনের সংসার। এই ২০ দিনের সংসারে ইয়াসিন ও তার পরিবারের কাছ থেকে সে যথেষ্ট সম্মান, ভালোবাসা ও আদর-স্নেহ পেয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কলি জানায়, ৭ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে পরিবারের সবাই মিলে রাতের খাবার খায়। এরপর কাজের কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয় ইয়াসিন। কিন্তু কী কাজ তা বলেনি। ৮ মে সকালে তারা প্রতিবেশীর মাধ্যমে জানতে পান মহানন্দার পাড়ে দুই বাংলাদেশি যুবককে গুলি করে মেরে ফেলেছে বিএসএফ। এক সময় তারা ইয়াসিনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়। তারপরের ঘটনাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে কিশোরী আফরোজা।

এদিকে ছেলের মৃত্যুর পর কিশোরী পুত্রবধুকে নিয়ে বিপাকে পড়ে ইয়াসিনের পরিবার। মেয়েটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা তাকে বরিশাল পাঠিয়ে দিতে চায়। কলির বাবা নেই। মা ও বড় দুই ভাই রয়েছে। কলি পালিয়ে আসার পর এ নিয়ে নানা তিক্ত ঘটনাও ঘটে তাদের মধ্যে। সে সব বিবেচনায় বরগুনায় যাওয়া নিয়ে অজানা ভয়-শঙ্কাও কাজ করছে ইয়াসিনের বাবা কিতাব আলীর মনে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে কলি বলেন, এখন আর কীসের ভবিষ্যৎ। যার জন্য পরিবার ছেড়ে এতোদূর এসেছিলাম সেই যখন নাই, এখন আর এখানে কীভাবে থাকবো। বাড়িতে মায়ের কাছে চলে যাবো। গ্রামে গিয়ে আবার স্কুলে ভর্তি হবো। এসএসসি পরীক্ষা দেব।

পাশে থাকা ইয়াসিনের মা জবেদা বেগম ও প্রতিবেশী কাবুল ইসলাম জানালেন, অল্প কয়েকদিনে বৌমা তাদেরকে খুব আপন করে নিয়েছিল। তাদের ভাষা রপ্ত করেছে। বাচ্চাদের সঙ্গে বড় বোনের মতো মিশে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কী হবে। মেয়েটির তো একটা ভবিষ্যৎ আছে।

সর্বশেষ গত ২৯ মে আফরোজা কলিকে পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় এক আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দেয় ইয়াসিনের বাবা কিতাব আলী। তিনি জানান, মেয়েটি অনেক ভালো ছিল। তার জন্য তাদের অনেক মায়া লাগবে। ছেলের মৃত্যুর শোকের চেয়ে এই শোক কোনো অংশে কম নয়। এটি যেন আরেকটি মৃত্যু।

‘হত্যার আগে নির্যাতন’

বিএসএফ কেবল গুলি করেনি। হত্যাকাণ্ডের আগে তারা ইয়াসিনের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে বলে জানালেন প্রতিবেশী কাবুল ইসলাম। তিনি জানান, ছেলেটিকে যখন নিয়ে আসা হয় তখন আমি তার পুরো শরীর দেখেছি। হাত-পায়ে, কোমরে প্রতিটি যায়গায় অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। রাইফেলের বাট দিয়ে তাকে পেটানো হয়েছে। পুরো শরীর থেতলে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি ওদের ধরে নিয়ে বিএসএফ একটি কক্ষে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখে। সেখানে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। সে নতুন বিয়ে করেছে সেটিও তারা জানতে পারে। আগে কোনোদিন ভারতে গিয়েছে কি-না সেটি তারা জানতে চায়। এসব পতাকা বৈঠকের সময় আমরা বিভিন্ন ভাবে জানতে পারি।

কাবুল বলেন, তারা যদি ছেলেটিকে মেরেই ফেলবে তাহলে প্রথমেই গুলি করে মেরে ফেলতো। আগে নির্যাতন করে পরে কেন গুলি করলো। আর গুলি করলে তো শরীরের অন্য জায়গায়ও করতে পারতো, গালের মধ্যে কেন গুলি করতে হবে?

এসময় ইয়াসিনের মা জবেদা জোরে চিৎকার করে ওঠেন। বিলাপ করে বলতে থাকেন, আমার বাবাটারে ওরা বহুত নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে।

সেদিন বিএসএফ ইয়াসিন আলীর মুখে এবং আব্দুল জলিলের মাথায় গুলি করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা এ প্রতিবেদককে জানান।

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিদ্বেষমূলকভাবে বাংলাদেশি তরুণ-যুবকদের হত্যা করে। নির্যাতনের পর গুলি করাটা চরম পর্যায়ের পৈশাচিকতা। এসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশিদের প্রতি তাদের ন্যূনতম সম্মানবোধ নেই।