মহানন্দা যেভাবে দখলে রেখেছে বিএসএফ

মহানন্দার পাড়। ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

মে মাসের শেষ সপ্তাহ, তাপপ্রবাহ চলছে। এর মধ্যেই দেশের উত্তর-পূর্বঞ্চলের সীমান্তঘেঁষা মহানন্দা নদী তীরে যান দ্য মিরর এশিয়ার এই প্রতিবেদক। তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধাগামী বাসে খয়খাটপাড়া-ভাঙ্গা মাদরাসায় নেমে কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে।

তারা জানান, মহানন্দা নদী মূলত পাথরের খনি। দিনের বেলা তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজারো মানুষ পাথর তোলার কাজ করেন। কৃষি ও চাবাগান থাকলেও এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষের বসবাস পাথরের সঙ্গেই। পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলো থেকে লোকজন এসে এখানে কৃষিকাজ করেন। কৃষিজমিতে কাজের চেয়ে পাথর তোলায় আয় বেশি। 

স্থানীয়রা জানান, কয়দিন আগে (৮ মে) বিএসএফের গুলিতে স্থানীয় যুবক ইয়াসিন নিহত হন। তিনিও নদীতে পাথর তোলার কাজ করতেন। কিন্তু কেউ হয়তো বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে ভিন্ন পথে নেন।

খাইরুল নামের একজন পাথর শ্রমিক বলেন, শুনেছি ছেলেটি খুব গরীব, আবার নতুন বিয়ে করেছে। তাই হয়তো এ পথে পা বাড়িয়েছে।

মহাসড়ক থেকে পশ্চিমে মাটির ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে প্রায় ১ কিলোমিটার গেলে মহানন্দা নদী। সেখানে একটি বাঁশ ঝাড়ের নিচে বসে কথা হয় বৃদ্ধ সিরাজুল ও কলেজছাত্র সাইদুলের সঙ্গে। তারা দূরে ইশারা করে দেখালেন- মূলত বাংলাদেশের সীমানা আরও দূরে। কিন্তু এখন মহানন্দা নদীর এই তীরকে বাংলাদেশের সীমানা হিসেবে বলা হয়। তাদের ভাষ্য, ভারত বাংলাদেশের ভেতরে এসে অনেক জায়গা দখল করে নিয়েছে।

বাংলাদেশের এই অংশে মহানন্দার তীর ব্লক দিয়ে বাঁধানো। বর্ষায় ভারত পানি ছেড়ে দিলে কখনো কখনো তীর উপচে পানি বাংলাদেশের স্থলভূমিও প্লাবিত করে। তখন বন্যার সৃষ্টি হয়। তা না হলে পুরো নদী ধু-ধু বালুচর। কোথাও কোথাও পাথর তোলায় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। 

সেখান থেকে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে খয়খাটপাড়া সীমান্ত এলাকার ৪৪৬ নম্বর মেইন পিলারের ১৪ (আর) কাছে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন চা শ্রমিক গাছের ছায়ায় বসে নাস্তা করছেন। পাশে টিউবওয়েল থেকে পাথর শ্রমিকরা পানি পান করছেন।

চা শ্রমিক সাইফুল ইসলাম নদীর ওপারে একটি বড় গাছ নির্দেশ করে বললেন, ওই খানে গত ৮ মে দুটি ছেলেকে মেরে ফেলে রাখে বিএসএফ। তারপর এখানে বসেই বিজিবির সঙ্গে পতাকা বৈঠকে লাশ হস্তান্তর করা হয়। 

তিনি বলেন, ভারত তো আমাদের মানুষই হত্যা করে না নদীটাকেও তো তারা হত্যা করেছে। আগে এই নদীতে কত পানি ছিল এখন শুধু চর আর চর। কোনো মাছ নাই। 

এসময় পাশে থাকা অন্য চা শ্রমিক ও দুজন পাথর শ্রমিকও সুর মেলালেন সাইফুলের কথার সঙ্গে। তারা জানালেন, আগে বর্ষাকালে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ থাকতো। এখন ভারত তাদের বন্যার পানি ছেড়ে দিলে এপারেও বন্যা হয়। এছাড়া নদীতে পাথর তুলতে গেলে বিএসএফের পাশাপাশি বিজিবিও শ্রমিকদের হয়রানি করে বলে অভিযোগ তাদের।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ৫৪টি যৌথ নদীর মতোই মহানন্দা একটি আন্তর্জাতিক নদী। তবে পদ্মা, টিপাই, তিস্তার মতো এই নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। ফলে এক সময়ের প্রমত্তা নদীটি এখন বালুময় খানাখন্দে রূপ নিয়েছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, দশকের পর দশক দিল্লির সঙ্গে পানি নিয়ে কূটনীতি চালাচ্ছে ঢাকা। যৌথ নদী কমিশন মাঝে মধ্যে নিয়ম রক্ষার বৈঠক করলেও তাতে কোনো ফল আসছে না। বাংলাদেশ তার ন্যায্য পানির হিস্যা না পেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতকে অতিরিক্ত সুবিধা দিচ্ছে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ভারত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক করেনি। তারা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক করেছে। যে কারণে তাদের ক্ষমতায় থাকার সুযোগ দিয়ে অন্যায় সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে। আমরা পানি না পেলেও তারা আমাদের ফেনী নদীর পানি পাচ্ছে। এটা নতজানু পররাষ্ট্র নীতির অংশ। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সরোয়ার মাহমুদ বলেন, মাত্র কিছুদিন হলো আমি এ পদে নিয়োগ পেয়েছি। কিছুদিন যাক বিষয়গুলো সম্পর্কে আগে ধারণা নিই। পরে এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে।