শোষণ ও অবহেলার শিকার অসহায় হজযাত্রীরা

হজ ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। শারীরিকভাবে সমর্থ্য ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল প্রত্যেক মুসলমানের জন্য হজ পালন করা বাধ্যতামূলক।

প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলমান হজ পালনের উদ্দেশে সৌদি আরবের মক্কা শহরে যান। এ বছর প্রায় বিশ লক্ষাধিক মুসলমান বিভিন্ন দেশ থেকে হজ পালনের উদ্দেশে সৌদি আরবে ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশিদের জন্য এ বছর কোটা ছিল ১,২৭,০০০। তবে শেষ হজ ফ্লাইট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে এবার ৮৫০০০ এর মতো হজযাত্রী সৌদি আরব এসেছে।

সৌদি রাজ পরিবার এই হজযাত্রীদের সেবা প্রদান করা নিজেদের জন্য পবিত্র দায়িত্ব বলে প্রচার করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় এবার হজযাত্রীদের ভোগান্তির মাত্রা ছিল অনেক বেশি। হাজারের বেশি হজযাত্রীর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। গরমে ও পানির অভাবে কীভাবে হজযাত্রীরা কষ্ট পেয়েছে তার কিছু চিত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রচারিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের ভোগান্তি ছিল অনেকটা দুধারি তরবারির মতো। বাংলাদেশ সরকারের শোষণ, অবহেলা এবং সৌদি সরকারের অব্যবস্থাপনা এই দুই যাতাকলেই পিষ্ট হতে হয়েছে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের যাদের বেশিরভাগই প্রবীণ ও শারীরিকভাবে দুর্বল।

ভোগান্তির শুরু হজযাত্রার আগেই

বাংলাদেশ সরকার হজযাত্রীদের শোষণ করা শুরু করে বিমান ভাড়ায় স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা থেকে জেদ্দায় বিমান ভাড়া গড়ে ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা এবং সেখানে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের কাছ থেকে ঢাকা-জেদ্দা বিমান ভাড়া নেয়া হয়েছে ৯৭০০০ টাকা এবং প্রতি হজযাত্রীর কাছ থেকে রাউন্ড ট্রিপ (ইকোনমি) ভাড়া নেওয়া হয়েছে ১,৯৪,০০০ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশি হজব্রতীদের দ্বিগুণেরও বেশি বিমান ভাড়া দিতে হবে। কেন?  

বাংলাদেশ ও সৌদি আরব সরকারের একটি চুক্তি অনুযায়ী শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং সৌরি আরবের সৌদিয়া এয়ারলাইন্স ও ফ্লাইনাস বাংলাদেশি হজযাত্রীদের বহন করতে পারবে। এই এয়ারলাইনগুলোকে হজযাত্রীদের পৌঁছে দেওয়ার পর খালি ফিরতে হয়ে বলে সেই ফিরতি ফ্লাইটের ভাড়াও হজযাত্রীদের থেকে নিয়ে থাকে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ সরকার ও কূটনীতিকরা কীভাবে এমন একটি নিবর্তনমূলক, শোষণমূলক ব্যবস্থা মেনে নিল?  এই হজযাত্রীদের বেশিরভাগ বহন করে থাকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স—যেমন: এবছর ৫০ শতাংশ হজযাত্রী বহন করেছে বাংলাদেশ সরকারের এই ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার। একাধিক সূত্র অনুযায়ী, হজযাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই অতিরিক্ত অর্থ দিয়েই ক্রমাগত লস দেওয়া এবং আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে। আর শোষিত হচ্ছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশি মুসলমানরা, যাদের বেশিরভাগই সারাজীবনের কষ্টার্জিত উপার্জন থেকে টাকা বাঁচিয়ে হজ পালন করতে আসেন।

সরকার কর্তৃক মূল্য নির্ধারণের নামে শুভংকরের ফাঁকি

হজ নিবন্ধন শুরু হওয়ার পর থেকেই সরকার জোর গলায় ঘোষণা দেওয়া শুরু করল যে, সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দুই পদ্ধতিতেই এ বছর হজ এর খরচ ৯০,০০০ টাকা কমানো হয়েছে। গণমাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচার করা হলো। আসলেই কি তাই? হ্যাঁ, সরকারি ব্যবস্থাপনায় যারা হজ এ এসেছেন তাদের খরচ ছিল ৬,৮৩,০০০ টাকা আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যারা এসেছেন তাদের খরচ হওয়ার কথা ৬৭২,০০০ টাকা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যার এসেছেন তাদের ক্ষেত্রে খরচ ঠিক থাকলেও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যারা এসেছেন তাদের ন্যূনতম খরচ হয়েছে ৭,০০,০০০ টাকা এবং বেশিরভাগ বাংলাদেশি হাজিই সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৮,০০,০০০ টাকা খরচ করেছেন। ৮৫০০০ এরও বেশি বাংলাদেশি হাজির মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এসেছেন মাত্র ৪৫৬২ জন আর বাকি সবাই এসেছেন বিভিন্ন বেসরকারি হজ এজেন্সির মাধ্যমে।

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আসা একজন বাংলাদেশি হাজি বলেছেন, “আমার কাছ থেকে প্রথমে এজেন্সি ৭,০০,০০০ টাকা চাইল। এরপর ভাল রুম দেবে এই কথা বলে আরো ১৫০,০০০ টাকা চাইল। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম রুম খুবই ছোট এবং রুমটি আরো দুই জন হাজির সাথে শেয়ার করতে হবে। অথচ এই রুমে কোনভাবেই একজনের বেশি থাকা সম্ভব না। আমি যখন প্রতিবাদ করলাম তখন সরাসরি জানিয়ে দেয়া হলো এটা মানতেই হবে, অন্যথায় রাস্তায় থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ তখন আর কোনো হোটেল রুমও খালি নেই।”

হজের দিনগুলোতে মক্কায় বহু বাংলাদেশি হাজির মুখেই আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে একই অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব এজেন্সির মতে, মক্কায় বাড়ি/হোটেল ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়া, খাবার খরচ বৃদ্ধি পাওয়া, কুরবানির খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাঁদের বাড়তি টাকা নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের হজ মিশন বা সৌদি আরবের বাংলাদেশের দূতাবাস এসব বাড়তি হোটেল/বাড়ি ভাড়ার খরচ নিয়ন্ত্রণে সৌদি সরকারের সঙ্গে কি কোনো আলোচনা করেছে? কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? অথবা সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেন আরো বেশি সংখ্যক হাজি নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে? 

কিছুই করেনি।

বরং বিপুল সংখ্যক হজযাত্রীদের কাছ থেকে হজ এজেন্সিগুলো যেন যাচ্ছেতাইভাবে টাকা নিতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছে সরকার। একটি মূল্য নির্ধারণের খবর প্রচার করেছে এবং সেটি বাস্তবায়নের তোয়াক্কা না করে হাত গুঁটিয়ে বসে থেকেছে।     

হাজিদের খাবারের মান

হজের দিনগুলোতে মক্কা যেন হয়ে ওঠে সুস্বাদু খাবারের এক মিলনমেলা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের আগমন  এবং তাঁদের রসনার তৃপ্তির জন্য মক্কার রেস্তোরাঁগুলোতে ২৪ ঘণ্টাই নানা পদের খাবার সবসময় তৈরি থাকে। আফ্রিকান, ইউরোপীয়, পাক-ভারত উপমহাদেশ বা দূর প্রাচ্যের সব খাবারই যে কোনো যায়গায় সবসময় পাওয়া যায়। কিন্তু এর মধ্যেও বাংলাদেশি হাজিদের খাবারের জন্য অত্যন্ত কষ্ট করতে হয়। বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো প্রতিদিন তিন বেলা খাবার সরবরাহ করার জন্য আগে থেকেই হাজিদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে রাখে। কিন্তু যে খাবার তারা সরবরাহ করে তা বেশিরভাগই বয়সে প্রবীণ হাজি স্বাস্থ্যগত কারণে খেতে পারেন না। মূলত এজেন্সিগুলো স্থানীয় বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ বা বাবুর্চিদের সাথে চুক্তি করে খাবার সরবরাহ করে থাকে যেগুলোর মান, রন্ধনপদ্ধতি প্রবীণ হাজিদের জন্য অনেকক্ষেত্রেই উপযোগী নয়। আবার, এজেন্সিগুলো তাদের সুবিধাজনক সময়ে খাবার সরবরাহ করে থাকে। রুমে খাবার গরম করা বা তাজা রাখার সুবিধা না থাকায় হাজিদের এসব খাবার নিয়ে রীতিমতো ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়।

একজন বাংলাদেশি হাজি মন্তব্য করেন, “এজেন্সিগুলো তাদের ইচ্ছা মতো সময়ে, ইচ্ছা মতো পদ দিয়ে খাবার দেয়। আমার খাবারের বিধিনিষেধ জানালেও তারা সেগুলো পাত্তা দেয় না। আমি সেজন্য বিরক্ত হয়ে তাদের খাবার দিতে মানা করে দিয়েছি এবং নিজ খরচে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাচ্ছি। আমি বলেছি, আমার খাবারের জন্য অগ্রিম দেওয়া টাকা আমাকে সমন্বয় করে ফেরত দিতে কিন্তু তারা তা দিচ্ছে না।”

অনেক হাজিই খাবারের জন্য অগ্রিম টাকা দেওয়ার পরে আর এর জন্য বাড়তি টাকা নিয়ে আসেন না। ফলে হজের এই ৩০-৪০ দিন খাবারের জন্য তাঁদের অবর্ণনীয় কষ্ট করতে হয় এবং অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।

মিনায় বাংলাদেশি হাজিদের অবহেলিত তাঁবু  

পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় মক্কা থেকে মিনায় ভ্রমণ করে সেখানে তাঁবুতে অবস্থান করার মাধ্যমে। একসময় হাজিদের নিজেদের তাঁবু নিজেরা বহন করে নিয়ে যেতে হত। পরে সৌদি সরকার মিনা উপতক্যায় বিপুল পরিমাণ তাঁবু স্থাপন করে। এসব তাঁবু হাজিদের মধ্যে দেশভিত্তিকভাবে বণ্টন করা হয়। বাংলাদেশি হাজিদের জন্য নির্ধারিত তাঁবুগুলো একসাথে থাকে। এবছর বাংলাদেশি হাজিদের জন্য নির্ধারিত তাঁবুগুলোর পাশেই ছিল পাকিস্তানি হাজিদের তাঁবু। রাস্তার বিপরীত পাশে ছিল ইন্দোনেশিয়ার হাজিদের তাঁবু।  

হজ এজেন্সিগুলোর মতে, বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও বাংলাদেশি হাজিদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মিনার একদম শেষ প্রান্তের তাঁবুগুলো। এসব তাঁবু থেকে জামারায় পাথর নিক্ষেপ এর জন্য হাজিদের হেঁটে অতিক্রম করতে হয়েছে ১০-১৫ কিলোমিটার; কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি। আবার অন্য সব তাঁবু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও বাংলাদেশি হাজিদের জন্য বরাদ্দকৃত তাঁবুতে সে ব্যবস্থা ছিল না। ফলে বহু হাজিকে গরমে অবর্ণনীয় কষ্ট করতে হয়েছে। হাজিদের তুলনায় শৌচাগারের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। শৌচাগার ব্যবহারের জন্য কোনো কোনো সময় ২০-৩০ জনের দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রবীণ হাজিদের যা তাঁদের জন্য ছিল অত্যন্ত কষ্টদায়ক। একই কষ্ট করতে হয়েছে আরাফাতে অবস্থানের তাঁবুতেও। 

আমার তাঁবুতে আমার চোখের সামনেই একজন প্রবীণ হাজি হিট স্ট্রোক করেন এবং বহু প্রচেষ্টার পরে তাকে সৌদি রেড ক্রিসেন্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ হজ মিশনের বা দূতাবাসের কেউই প্রয়োজন বোধ করেননি বাংলাদেশি হাজিদের অবস্থা সরেজমিনে একবার দেখার।  

দীর্ঘ পদযাত্রায় অসুস্থ অসংখ্য হাজি

হজ পালনের অন্যতম কঠিন একটি কাজ হল মুজদালিফা থেকে মিনা হয়ে জামারায় গিয়ে তিনটি শয়তানের মধ্যে বড় শয়তানের উদ্যেশ্যে পাথর নিক্ষেপ করা, কুরবানি করা এবং আবার মিনার তাঁবুতে ফিরে আসা। মিনায় অবস্থান করে পরের দুই দিন পাথর নিক্ষেপ করা এবং দ্বিতীয় দিন মক্কায় ফিরে যাওয়া। বাংলাদেশি হাজিদের তাঁবু মিনার একদম শেষপ্রান্তে হওয়ায় প্রত্যেকটি জায়গায় যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটতে হয়েছে।

মিনা থেকে জামারায় আসা যাওয়া এবং এরপর মক্কায় যাওয়া সব মিলিয়ে একজন হাজিকে প্রায় ২০-২২ মাইল পথ একদিনে হেঁটে অতিক্রম করতে হয়েছে। একাধিকবার হজ করেছেন এমন হাজিদের মতে, এই দীর্ঘ পথের মাঝে মাঝে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা পানি, জুস, ছাতা ইত্যাদি সামগ্রী নিয়ে হাজিদের সেবার জন্য উপস্থিত থাকে। তবে এবার এই সেবা ছিল একদমই অপ্রতুল। যার ফলে বিপুল পরিমাণ হাজি অসুস্থ হয়ে পড়ে যার বিভিন্ন ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রচারিত হয়েছে।     

সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সেবায় ঘাটতি থাকলেও বিভিন্ন দেশের সরকার এবং ওইসব দেশের দানবীরেরা তাঁদের দেশের হাজিদের জন্য সেবা দিতে কার্পণ্য করেননি। যেমন: তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার হাজিদের জন্য সে দেশের সরকার বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করেছে। পাকিস্তানের কিছু হাজিদের জন্যেও এধরনের পরিবহন সেবা ছিল। ভারতীয় হাজিদের জন্য সে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষ থেকে খাবার স্যালাইন, ছাতা, পানির বোতল সরবরাহ করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় বিভিন্ন দেশের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক, চিকিৎসক দলের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।   

দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা এই যে, মিনা, আরাফা এবং জামারায় পাথর মারার দিনগুলোতে বাংলাদেশের হাজিদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ সেবা প্রদান করতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশের হাজিরা অন্যান্য দেশের হাজিদের থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিলেও সেবা প্রাপ্তির জায়গায় তারা ছিলেন সম্ভবত সর্বনিম্ন পর্যায়ে।  শুধু আফ্রিকার কিছু দরিদ্র দেশের হাজিদের এবং অনিবন্ধিত বা অবৈধভাবে আসা হাজিদের অবস্থার সাথে বাংলাদেশের হাজিদের অবস্থা তুলনাযোগ্য।     

সরকার কি আদৌ কিছু ভাবছে?

বাংলাদেশি হাজিদের এই দুরবস্থা নিয়ে জেদ্দায় অবস্থিত বাংলাদেশ কনসুলেট এ অনেকেই অভিযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। কনসুলেটের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, বাংলাদেশ হজ মিশন এবং দূতাবাসের কর্তারা মনে করছেন যে, বাংলাদেশের হাজিদের দূরবস্থার মূল কারণ আমাদের হাজিরা হজের টাকা একবারে না দিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দিয়ে থাকেন। এর ফলে বাংলাদেশ সরকার, সৌদি সরকারের কাছে পর্যাপ্ত টাকা জমা দিয়ে হাজিদের জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে তাঁবু বরাদ্দ নিতে পারে না। বরং যে তাঁবুগুলো কোন দেশ নিতে রাজি হয়না, সেগুলোই বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করা হয়। তাঁদের পরামর্শ হলো, আগামি বছর হাজিদের কাছ থেকে একবারে পুরো টাকা নিয়ে সেখান থেকে সৌদি সরকারকে দ্রুত টাকা দিয়ে আগেই তাঁবু বরাদ্দ নিতে হবে।

এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, যেখানে বাংলাদেশ সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায় সেখানে সৌদি সরকারের কাছে টাকা জমা দিয়ে কিছু তাঁবু বরাদ্দ পাওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করতে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে হাজিরা কবে টাকা জমা দেবে তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। আর এই পদক্ষেপ সত্যিই নেওয়া হলে তা হবে বাংলাদেশের হাজিদের জন্য আরেকটি বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত। অনেকের পক্ষেই একবারে সাত থেকে আট লক্ষ টাকা দেওয়া সম্ভব হবে না এবং বাংলাদেশিদের জন্য হজযাত্রা আরো কঠিন হয়ে উঠবে।  এ বছরই বাংলাদেশ হজযাত্রার জন্য বরাদ্দকৃত কোটা পূরণ করতে পারেনি। টাকা জমা দেওয়ার সময়সীমা কয়েকদফা বৃদ্ধি করেও আশানুরূপ হজযাত্রী পাওয়া যায়নি।

হজ শুধু ধর্মীয় দায়িত্বই নয়, ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশি মুসলমানদের জন্য হজ একটি আবেগের জায়গা। যত প্রতিকূলতা, অস্বচ্ছলতাই থাকুক না কেন বাংলাদেশি মুসলমানরা চায় পুরো জীবনে একবার হলেও হজ পালন করতে। যার ফলে প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে বড় সংখ্যায় হাজিরা সৌদি আরব আসেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পতন, সরকারি কর্তাদের নির্লিপ্ততা এবং বিভিন্ন হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে হজপালন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে যা অত্যন্ত হতাশাজনক।

আগামি বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকারকে চিন্তা করতে হবে কীভাবে হজযাত্রীদের জন্য সেবার মান বৃদ্ধি করা যায় এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় আরো বেশি সংখ্যক হজযাত্রী নেওয়া যায়। প্রতিবছর বাংলাদেশ হজ মিশনে বিপুল সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সৌদি আরব আসেন হাজিদের সেবা দেওয়ার জন্য। জেদ্দায় বাংলাদেশ হজ অফিসেও বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। অর্থাৎ হাজিদের পর্যাপ্ত সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কাঠামোগত সক্ষমতা আছে কিন্তু নেই কোনো সদিচ্ছা।