ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটে ফের বন্যা

গত দু'দিনের ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে সিলেটের ৩ উপজেলায়। দ্রুত বাড়ছে সুরমা-কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি।

সোমবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় সিলেটে ৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ৩৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।

সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার সকালেও সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। চেরাপুঞ্জি ও সিলেটের বৃষ্টিপাতের কারণে দ্রুতগতিতে বাড়ছে নদ-নদীর পানি।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. শাহ্ সজিব হোসেন জানান, সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫৬ দশমিক ৪ মিলিমিটার। এর মধ্যে বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বিকালের পর থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট অফিস থেকে জানানো হয়েছে, অতিবৃষ্টির কারণে সিলেটের নদ-নদীগুলোর ৪টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং জৈন্তাপুরে সারি নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এছাড়া জকিগঞ্জের আমলসিদ পয়েন্টে কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ২৮ মিলিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিপৎসীমার উপরে থাকা ফেঞ্চুগঞ্জে একই নদীর পানি কিছুটা বেড়ে বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া বাকি ৭ পয়েন্টেও নদীর পানি আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে।

এদিকে, অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে পুনরায় সিলেটের কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব এলাকায় বাড়িঘর, বাজার-দোকানপাট প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া মহানগরের উপশহর এলাকা আবারও প্লাবিত হয়েছে।

মাত্র ৩৫ দিনের মধ্যে সিলেটে তৃতীয়বার বন্যার কবলে পড়ল সিলেট। দ্বিতীয় দফার বন্যায় ৭ লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি। এরই মাঝে অবিরাম বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সোমবার (১ জুলাই) নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে জেলার ৩টি উপজেলায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন- আগামী ৪ দিন সিলেটে ও উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা হলে সিলেটে নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।

সিলেটে গত ২৭ মে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ২ সপ্তাহ ব্যাপী স্থায়ী এ বন্যায় পানিবন্দি ছিলেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রথম বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন থেকে ফের বন্যা হয় সিলেটে। ১৭ জুন ঈদুল আজহার দিন ভোররাত থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিভারী বর্ষণে মহানগরসহ  সিলেটের সব উপজেলায় লাখ লাখ মানুষ হয়ে পড়েন পানিবন্দি। পরবর্তী এক সপ্তাহ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। এরপর পানি নামতে শুরু করে। তবে সে গতি ছিল খুব ধীর।

দ্বিতীয় দফা বন্যা শেষ হওয়ার আগেই সোমবার (১ জুলাই) থেকে সিলেটে ধাক্কা দেয় তৃতীয় দফা বন্যা। গত রবিবার (৩০ জুন) ও সোমবার দিনভর সিলেটে থেমে থেমে ও উজানে ভারী বৃষ্টির ফলে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলার যেসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছিল সেসব এলাকা ফের প্লাবিত হয়েছে।

জানা যায়, সোমবার সকালে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কানাইঘাটে সুরমা ও লোভা নদীর পানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। ফলে আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা ডাইকের অন্তত ১৮টি স্থান দিয়ে সুরমা ও লোভা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত জনপদ ফের বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। নতুন করে প্লাবিত বাড়ি-ঘরের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যাচ্ছেন।

এছাড়া বিভিন্ন বাজার তলিয়ে পানি ঢুকেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। এতে নতুন করে ক্ষতিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া প্লাবিত হয়েছে গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা। ফলে তৃতীয় দফা ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড  সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস জানান, গত ৪৮ ঘণ্টায়  সিলেটের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

এছাড়া সিলেটে রবিবার সকাল ৬টা থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ২৬০ মিলিমিটার। আগামী ৪ দিন ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি সিলেটে আবারও ভয়াবহ হবে।

এদিকে সোমবার রাত পৌনে ৯টায় সিলেট জেলা প্রশাসন থেকে বন্যা পরিস্থিতির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে সিলেটের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৯ হাজার ৫৬৮ জন মানুষ রয়েছেন। সিলেট মহানগরে নতুন করে বন্যা দেখা না দিলেও সদর উপজেলাতে ৩৫টি গ্রামে পুনরায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বাকি ১২টি উপজেলায় ১ হাজার ৮১টি গ্রামের ৭ লাখ ৩৩৬ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছেন।

বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও প্রত্যেক উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে কন্ট্রোল স্থাপন করে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম গঠন করে বন্যার্ত অসুস্থ মানুষকে প্রদান করা হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা।

বন্যা পরিস্থিতির তথ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, জেলায় অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের ফলে জেলার অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোর পানি ৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রবিবার দুপুর থেকে চলমান বৃষ্টির কারণে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।