ভঙ্গুর দেশের দৃঢ়চেতা নেতা

জিয়াউর রহমান। ফাইল ছবি।

পুরো পৃথিবীর জনসংখ্যাকে যদি এখন আমেরিকা মহাদেশে এনে ফেলা হয়, তবে সেখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে বাংলাদেশের মতো।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার এই চিত্র আতঙ্কিত হওয়ার মতো। এই চিত্র দেখেই উন্নয়ন সহযোগীরা আকৃষ্ট হয়েছেন এবং দেশটির প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। 

মানুষের গড় আয়ু ৪৭ বছর। পাঁচ বছরের কম বয়সী ৮০ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। সমগ্র জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ রক্তশূন্যতায় ভুগছে। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে মাত্র একজন পড়তে পারে।

কৃষিতে সক্ষমতা বাড়া ও প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য সত্ত্বেও মানুষের প্রধান খাদ্য চাল গ্রহণের হার ২০ বছর আগের তুলনায় কম।

এমন বাংলাদেশকে নিয়ে হতাশ হওয়ার অনেক কারণ আছে। অনেকে হতাশ হচ্ছেনও। কিন্তু গত কয়েক বছরে কিছুটা আশা দেখা গেছে। সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও ভালো হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।

গত সপ্তাহে যখন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টার সময় বুলেটের শিলাবৃষ্টিতে নিহত হন, তখন সেই আশার অনেকগুলিই তার সঙ্গে ভুলুণ্ঠিত হয়। এর অন্তত দুটি কারণ ছিল। ৪৫ বছর বয়সে তার মৃত্যু জাতিকে এমন একটি সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত করেছিল যার শেষ কেউ দেখতে পারেনি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টার জন্য খুব কমই ভালো হতে পারে।

১৯৭৫ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়া এশিয়ার অন্যতম কার্যকর সরকারপ্রধান হয়ে উঠেছিলেন। তার শাসনামলে দেশটি উন্নতি করতে শুরু করেছিল। যদিও এটি ছিল এক-মানুষের প্রদর্শন এবং তিনি যা করেছিলেন তার বেশিরভাগই এই প্রাচীন দেশের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। যিনি শেষ পর্যন্ত তার স্থলাভিষিক্ত হন, সাধারণ বা বেসামরিক রাজনীতিবিদই হোক না কেন, একই পথ অনুসরণ করার সম্ভাবনা নেই।

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২,০০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উইসকনসিনের চেয়ে ছোট একটি ভূমিতে বসবাস করবে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান (যিনিও প্রায় ছয় বছর আগে হত্যাকাণ্ডে মারা গিয়েছিলেন) জনসংখ্যার ব্যাপারে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে বলতেন, “আমরা মুসলমানরা আমাদের সন্তানদের ভালোবাসি। সন্তান বেশি হলে আল্লাহ তায়ালাই দেখবেন।”

অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি জিয়া একজন কঠোর শাসক ছিলেন। প্রাক্তন এই সেনা কর্মকর্তা শেখ মুজিবকে হত্যার কয়েক মাস পরে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিনি জনসংখ্যাকে বারবার দেশটির প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি অনেকটা সামরিক কায়দায় এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি শহর থেকে গ্রামে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সচেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যা কাজও করতে শুরু করেছিল। 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী এম এ মতিন এক বছর আগে আশাবাদী হয়ে বলেছিলেন, “এই প্রথম একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং একটি ইসলামিক দেশের নেতা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেছেন।”

রাষ্ট্রপতি জিয়ার জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি “শান্তিপূর্ণ বিপ্লব”-এর অংশ। তার অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সাক্ষরতা অভিযান, জমির সম্প্রসারিত সেচ এবং উচ্চ ফলনশীল বীজের জাত প্রবর্তনের মাধ্যমে পাঁচ বছরের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা।

জিয়াউর রহমান অক্লান্তভাবে হেলিকপ্টারে করে বাংলাদেশের চারপাশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এভাবে তিনি ঢাকার বাইরে মাসে ২০ দিন ব্যয় করতেন। এসবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি পরিবর্তনের বার্তা দিয়েছেন; যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

“আমার মনে আছে জিয়া গত বছর একদিন এখানে এসেছিলেন এবং তিনি সেচের খালের কথা বলেছিলেন।” রাজধানী থেকে ৩০ মাইল উত্তরে জুলাল গ্রামের এক কৃষক গত সপ্তাহের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, “কিন্তু এটা শুধু কথা ছিল না। একটি খাল আসলে নির্মিত হয়ে গেছে। এখন সেই খালের মাধ্যমে জমিতে সেচও দেওয়া হচ্ছে। আমরা শুকনো মৌসুমে অতিরিক্ত ফসল পেতে পারি। এর আগে, কোনো নেতা এমনটি করেননি। জিয়াকে আমরা খুবই মিস করব। আমরা খুবই দুঃখিত।”

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে জিয়াউর রহমানের মতো রাজনীতিবিদ খুব কমই এসেছে। এখন নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে কিছু নেতা ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হতে পারেন। তবে এই ক্ষমতার মসনদ অনেক পিচ্ছিল। যেখানে যে কোনো সময় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বা খুনের নকশা করে ক্ষমতার এভাবে পালাবদল ঘটানো যায়।

এখন সরকারের কেন্দ্রে শূন্যতা বিরাজ করছে। এই শূন্যতা কে পূরণ করতে পারবে সেটি কেউ জানে না। রাষ্ট্রপতি জিয়ার বিএনপি বা বিরোধী আওয়ামী লীগ (শেখ মুজিবের দল) কারোরই নির্দিষ্ট রাষ্ট্রপতি প্রার্থী নেই। দুটি দলেই গুপিং জেঁকে বসেছে।

বাংলাদেশকে কঠিন এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হতে হয়েছে; এতে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। জিয়ার মৃত্যুর পর সাবেক প্রধান বিচারপতি আবদুস সাত্তার, যিনি ৭৫ বছর বয়সে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছেন বলেছেন, “আমাদের প্রিয় শহীদ নেতার রেখে যাওয়া গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য।”

সমালোচকরা রাষ্ট্রপতি জিয়ার গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। তারা বলেছে, এই সরকার অবশ্যই স্বৈরাচারী ছিল। তবে গেল কয়েক দিনে এটি স্পষ্ট হয়েছে, জিয়ার রেখে যাওয়া শাসনকার্য যেভাবে প্রচলিত হয়েছে তার চেয়েও উত্তম ছিল।

তবে সামনের দিনগুলো সুখকর হবে না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে তা অবধারিতভাবেই বলা যায়। ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীলতা দানা বেধেছে। সারাদেশে অফিস, মন্ত্রণালয়, সংসদ ও সামরিক কর্মকর্তাদের কোয়ার্টারে দৌড়ঝাপ শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে মাঝরাতের আলোচনা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? পশ্চিমা বিশ্বের অনেকে জিজ্ঞেস করেন, এটি যেন কোনো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগী। উত্তর হলো- অবশ্যই পারবে। দেশটি হারিয়ে যাবে না। এখানকার ৯২ মিলিয়ন বাংলাদেশি, শীঘ্রই ১০০ মিলিয়ন হবে। হয়তো মাঝে মাঝে তাদের অবস্থা কিছুটা খারাপ হবে। আবার ভালো হবে। তবে কিছুদিন আগে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাকে খারাপই বলতে হবে।

নিবন্ধটি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত। সংবাদপত্রটির প্রিন্ট সংস্করণে ১৯৮১ সালের ৭ জুন প্রকাশিত হয়েছিল নিবন্ধটি।