ভূ-রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও কর্তৃত্ববাদ বনাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

প্রতীকী ছবি

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, আরও বৃহত্তর পরিসরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি এখন সারাবিশ্বেই আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছে। কী উন্নত কী তৃতীয় বিশ্ব;  উভয় ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ন্যায় বিচারের গ্যারান্টি ইত্যাদি এ সবই যেন অরওয়েলের ‘বিগ ব্রাদারদের’ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

এক সময় পশ্চিমা গণমাধ্যম আমদের মুগ্ধ করতো। আমরা ভাবতাম আহা! এই স্বাধীনতা যদি আমরা পেতাম। কিংবা অতো দূরে নয়, প্রতিবেশী ভারতের গণমাধ্যম এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও একসময় আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাতো। আসলে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগটাই ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতার এক স্বর্ণযুগ। এখন পশ্চিমা মিডিয়ার ভূমিকাও প্রশ্নাতীত নয়। তারা দ্বৈত ভূমিকায় দ্বিখণ্ডিত। অর্থাৎ, আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা আবাদ ও ন্যায়নীতি ভিত্তিক। কিন্তু বহির্বিশ্বের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সরকারি নীতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে পথচলা। তাই আমরা দেখতে পাই যে, ২০০৩ সালে ইরাকে মর্কিন আগ্রাসন চালাবার পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল মার্কিন মিডিয়া। তখন মার্কিন মিডিয়ায় এই খবর প্রকাশিত হয় যে, ইরাকের কাছে ব্যাপক গণবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র আছে। যা পরবর্তীতে ডাহা মিথ্যা হিসাবে প্রমাণিত হয়।

আসলে ওটা ছিল একটা অজুহাত, যা মিডিয়া তৈরি করেছিল। মূলত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং শীতল যুদ্ধের অবসানের পর ইরাক আক্রমণের মধ্য দিয়ে আমেরিকা বিশ্ববাসীকে বুঝাতে চেয়েছিল যে, একবিংশ শতাব্দী মানে আমেরিকার শতাব্দী। আর এই শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস যেন কেউ না দেখায়।

অথচ, সোভিয়েত কমিউনিস্ট ব্লকের পতনের পর এ ধারণা জন্মেছিল যে, একক পরাশক্তি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইউরোপীয় সভ্যতা তৃতীয় বিশ্ব থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাবে। সুচিত করবে অবাধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যা নিশ্চিত করবে মানুষের কথা বলার অধিকার, নিশ্চিত করবে ন্যায় বিচার ও সুশাসন, প্রতিষ্ঠা করবে মানবাধিকার। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম যে, সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন দূরের কথা, বরং তা বিংশ শতাব্দীর থেকে আরো খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে।

বিশেষ করে পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক, আফগানিস্তান, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সবশেষ গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় নিঃশর্ত সমর্থন- গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার সম্পর্কে পশ্চিমাদের মানদণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আর এ সব অন্যায় কর্মকাণ্ডকে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো চোখ বন্ধ করে সমর্থন করায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাতাকলে পিষ্ট গণমাধ্যম দিশেহারা অবস্থায় বিরাজ করছে।

এর প্রধান কারণ হচ্ছে- ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে নবতর মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে, তা সোভিয়েত উত্তর একমুখী বিশ্ব ব্যবস্থার স্থলে বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থা সৃষ্টি  করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর মাত্র পনের বছরের মধ্যেই আমেরিকাকে বহুমুখী বিশ্বকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কারণ পরাশক্তি হিসাবে  রাশিয়ার পুনরুত্থান, বৃহৎ শক্তি হিসাবে চীনের আবির্ভাব এবং উভয় শক্তির মধ্যে সখ্যতা এক নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। যা মোকাবিলায় ফ্যাসিবাদী শাসকদের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র হাত মিলাতে দ্বিধা করছে না। যেমন চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভারতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তোলা। অথচ ভারতে এখন চলছে ফ্যাসিবাদী শাসন। সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিজেপি সরকারের ইচ্ছাধীন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অসংখ্য মিডিয়া তৈরি করে গোয়েবলীয় স্টাইলে প্রচারণা চালানো হয়, যাকে কটাক্ষ করে বলা হয় ‘গদি মিডিয়া’। এর ফলে ভারতের আশপাশের ছোট ছোট দেশগুলোর জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও মুখ থুবড়ে পড়ছে। বাংলাদেশ তার একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত। এ দেশটিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কর্তৃত্ববাদী শাসনের আজ্ঞাবাহী। অর্থাৎ, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের করুন দশার অবশ্যম্ভাবী করুণ পরিণতি হচ্ছে গণমাধ্যমের ওপর শাসনের খড়গ।

মূলত শীতল যুদ্ধের অবসানের পর সারা বিশ্বে আমেরিকার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অভিলাস চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণমাধ্যম একই ভূমিকা পালন করে। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন পরিচালনার পটভূমি পশ্চিমা মিডিয়াই তৈরি করেছিল। তখন মার্কিন মিডিয়ায় প্রকাশিত হলো যে, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ রয়েছিল। পরবর্তীতে এটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আসলে একবিংশ শতাব্দী হবে একান্তই আমেরিকার; যাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ থাকবে না।