দলদাস মিডিয়া

সরদার ফরিদ আহমদ

বলা হয়- চারটি বিষয় বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। এগুলো হলো রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম। আর এই চারটি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে অন্য একটি বিষয়। সেটি মিডিয়া।

মিডিয়ার পরিধি আর আগের মতো নেই। এটিতে যেমন প্রয়োগের ধরন বদলেছে, ঠিক তেমনি আকারটি এত বিশাল হয়েছে যেটি আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। আগে আমরা মিডিয়া বলতে বুঝতাম পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও এবং চলচ্চিত্র। এলো অনলাইন। পত্রিকা, টেলিভিশন ও রেডিও-কে এক জায়গায় নিয়ে এলো অনলাইন মিডিয়া। এরপর হাজির হলো সর্বগ্রাসী সোশ্যাল মিডিয়া।

এখন একটি প্রশ্ন মোটা দাগে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মূলধারার মিডিয়া সোশ্যাল মিডিয়ার সামনে শেষ পর্যন্ত টিকবে তো? প্রশ্নটি এসেছে প্রধানত একটি কারণে। বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন জগতের নিয়ন্ত্রণ কার থাকবে? পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ার নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার? এই প্রশ্নের জবাবও মিলতে শুরু করেছে। সংকুচিত হচ্ছে পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ার বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন চলে যাচ্চে অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। মিডিয়ার ব্লাড হলো বিজ্ঞাপন। ব্লাড সরবরাহ বন্ধ হলে সেই মিডিয়া কি বাঁচবে? বাঁচবে না। মরে যাবে। এই হিসাবে অনলাইন মিডিয়ার সামনে এখন রিরাট সুযোগ। তরে এর জন্য প্রথম শর্ত কোয়ালিটি।

দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে বর্তমানে বাংলাদেশে পত্রিকা ও টিভি মিডিয়া দুর্বল এবং একপেশে। সরকার এ পর্যন্ত ২০৪টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল অনুমোদন দিয়েছে। আর অনুমোদন পাওয়া আইপি টেলিভিশনের সংখ্যা ১৪টি। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুমোদন পাওয়া এসব নিউজ পোর্টাল ও আইপি টেলিভিশনের বেশিরভাগেরই কোনো অফিস নেই। এক ব্যক্তিই প্রকাশক এবং সম্পাদক। এসব নিউজ পোর্টাল ও আইপি টেলিভিশনের সম্পাদকরা মূলত অসাংবাদিক, অনভিজ্ঞ, অপেশাদার এবং দলদাস। এসব নিউজ পোর্টাল ও আইপি টেলিভিশন গুলোতে আর যাই হোক সাংবাদিকতার ছিটেফোঁটাও নেই। হাতেগোনা তিন কী চারটি নিউজ পোর্টাল হয়তো পড়া যায়, আবার সেগুলোও শাসক দলের একান্ত অনুগত। আর কিছু নিউজ পোর্টাল ব্যক্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ভূমিদস্যুদের হাতিয়ার।

বাংলাদেশের মানুষ নিউজের জন্য কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের ওপরই নির্ভর করে। দু-একটি বাদে এগুলোও হয় সরকার সমর্থক না হয় প্রতিবেশির দেশটির স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। ফলে বাংলাদেশের মিডিয়ার অধোগতিও অব্যাহত রয়েছে।

আমরা জানি, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৬৫ নম্বর। এটি অশনিসংকেত। এটি শুধু সাংবাদিকদের জন্যই নয় দেশ ও গণতন্ত্রের জন্যও আতঙ্কজনক।

সাংবাদিকতার নীতিমালা কী- এই প্রশ্নের একাডেমিক উত্তর আছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল খুবই কম। অনেক সাংবাদিক এই বিষয়টি জানেনই না। সাংবাদিকতা একটি পেশা, তবে আর দশটা পেশা থেকে ভিন্নতা রয়েছে। সাংবাদিকরা জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশাল সামাজিক দায়িত্ব বহন করবেন- বহন করা উচিত-এটাই অনেকে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রে এখন সাংবাদিকরা প্রায়ই প্রতিবেদনে নিজেই ঢুকে পড়েন, মতামত দেন, অভিমত প্রকাশ করেন। রাজনৈতিক দলের নেতাদের কিংবা পুলিশের বক্তব্য হুবহু প্রকাশ করাকে অনেকে সাংবাদিকতা মনে করেন। তাদের দেওয়া বক্তব্য এবং তথ্যকে যাচাই-বাছাই করার কাজটি আর এখন সাংবাদিকরা করেন না।

মিডিয়ার পলিসি বা নীতি নিয়ে কথা বলা মুশকিল। বর্তমানে আমাদের দেশে মিডিয়ার পলিসি জনগণ বা দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে হয় না। বলা যায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আসলে আসলে ‘গণ’ নেই। আছে রাজনৈতিক মেরুকরণ, গোষ্ঠীপ্রীতি, ব্যাক্তিস্বার্থের জাল বিস্তার এবং মিডিয়ার মালিকের স্বার্থ রক্ষা। বিশ্বের কোনো দেশেরই কোনো মিডিয়া এমন পলিসি নেয় না যাতে নিজ দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, গণতন্ত্র এবং ভাবমর্যাদার ক্ষতি হয়। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। এখানে ব্যক্তি,  গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। দেশ ও দেশের মানুষের কী ক্ষতি বা লাভ হচ্ছে সে বিষয়টি বাংলাদেশের এখন একেবারেই উপেক্ষিত। তবে পাঠক ও দর্শকরা খুব সহজেই যেকোনো মিডিয়াকে চিহ্নিত করতে পারেন সেটি কোন দল বা গোষ্ঠীর সমর্থক। কেন সমর্থক সেটিও তারা জানেন।

বাংলাদেশে মানসম্পন্ন ও দেশপ্রেমিক মিডিয়ার বিশাল সঙ্কট চলছে। এই সময় দেশপ্রেমিক মিডিয়ার বড্ড প্রয়োজন। যে মিডিয়া দেশ ও দেশের মানুষের পক্ষে সোচ্চার হবে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে পক্ষে দাঁড়াবে কঠিনভাবে। দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দিয়ে জনগণের কাঠগোড়ায় তুলবে।

আশা করি, দ্যমিররএশিয়া ডটকম সেই কাজটি করবে।

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন