সবার জন্য গণমাধ্যম আর নেই: আফসান চৌধুরী

 

চার দশকের বেশি সময় ধরে ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন আফসান চৌধুরী। হাসান হাফিজুর রহমানের অধীনে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র’ প্রকল্পের অন্যতম গবেষক ছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখক দেশের গণমাধ্যম নিয়ে কথা বলেছেন।

দ্য মিরর এশিয়া: বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্ণ করল। এ সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম আপনি কেমন দেখলেন?

আফসান চৌধুরী: প্রশ্নটা একমাত্রিক নয়, জটিল। গণমাধ্যমকে রাষ্ট্র আর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায় না। একাত্তর থেকে যদি বলি, ওই সময় আমরা রাষ্ট্রের কথা অনেক বলি। কিন্তু সমাজের কথা অনেক কম বলি। গ্রামের মানুষকে কিন্তু রাষ্ট্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে আমরা দেখি না। আমরা ভাবি, নিজেরা যা চিন্তা করছি ওটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এখনও গ্রাম আর শহর এক না। যদিও অনেক কিছুর মাধ্যমে যোগাযোগ আছে, গণমাধ্যমের মাধ্যমেও যোগাযোগ আছে। গ্রাম আমাদের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। গণমাধ্যমকেও দেখতে হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কোন মাধ্যমটিকে বেছে নিচ্ছে, তার আলোকে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মূলধারার গণমাধ্যমকে বেছে নিচ্ছে না। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নিচ্ছে। তার মানে তাদের এটার প্রয়োজন নেই। গবেষণায় এটি উঠে আসছে যে, মূলধারার গণমাধ্যমের প্রভাব সীমিত হয়ে আসছে। কারণ মূলধারার গণমাধ্যম মূলত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। যেমন: বাজেট কেমন হলো, আইএমএফ টাকা দিলো কিনা, দুর্নীতির কী অবস্থা এসব নিয়ে পড়ে আছে। গ্রামের বা অধিকাংশ মানুষের কথা গণমাধ্যমে আসছে না।

জাতীয় গণমাধ্যম হয়েছে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বস্তুতপক্ষেই দেশের সমাজের। তাই গণমাধ্যমের গুরুত্ব নিরূপণ করতে হলে বুঝতে হবে- রাষ্ট্র আর সমাজ এক বাস্তবতা না। সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যম এত জনপ্রিয় বা ব্যবহৃত হচ্ছে এই কারণে যে, সমাজে রাষ্ট্রের প্রয়োজন সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র নিজে থেকে আছে, সরকার চালায়। গণমাধ্যমের দুর্বলতা যদি বলতে হয়, তারা সামাজিক যেসব বিষয় আছে, দুনিয়া আছে যেখানে বিশাল মানুষ বাস করে সেটি নিয়ে রিপোর্টিং করছে না, বা করলেও খুব কম করছে। সে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর রিপোর্টিং করে। এটাকে ভালো বা খারাপ বলব না, এটাই বাস্তবতা।

টিএমএস: আপনি অনেকদিন গণমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করেছেন। যখন কাজ করেছেন তখনকার সঙ্গে এখনকার গণমাধ্যমের কী পার্থক্য দেখেন?

আফসান চৌধুরী: ১৯৭৩ সাল থেকে আমি গণমাধ্যমে কাজ করি। তখন গণমাধ্যম ছিল খুব সীমিত পরিসরে। অবস্থা এতটা ভালো ছিল না। মার্শাল ল পিরিয়ডে আমরা জানতাম- কি বলতে হবে, কি বলা যাবে না। তা ছাড়া অনেক সময় অনেক কথা বলা হয়েছে। এখন সেটা বোধহয় কম। এখন অনেকটা রাজনীতি কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। এখন অধিকাংশ খবরই কে কী বলল- এসব নিযে; টক শো হচ্ছে একই বিষয় নিয়ে। সাধারণ মানুষের কথা সেখানে নেই, আছে রাজা-উজিরের গল্প। বেশিরভাগ পত্রিকা বা টিভির মালিকানা পেয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আমরা রাজনীতি করলেও গণমাধ্যমে রাজনীতি চর্চা করিনি। আজকের দিনে রাজনীতি চর্চা করাটা বৈধ মনে করা হয়। আমাদের সময় এটা সুনজরে দেখা হতো না। আমাদের সময় বামপন্থীরা রাজনীতিতে ছিল, এখন তো বামপন্থাই নেই।

আগে চেষ্টা করা হয়েছে পরিবর্তনশীল সমাজটাকে, সময়টাকে ধরতে। এখন পরিবর্তনশীল সমাজের চেয়ে রাজনীতিতে গণমাধ্যমের আগ্রহ বেশি। এটা নিয়ে সাধারণ মানুষ কি এতটা আগ্রহী? আমি তো রাষ্ট্রের ব্যাপারে মানুষের এতটা আগ্রহ দেখি না। আমাদের গণমাধ্যম সমাজে যে ঘটনাপ্রবাহ ঘটছে সেটি নিয়ে খুব কম রিপোর্টিং করছে। একটি উদাহরণ দিই, এই যে প্রবাসী শ্রমিক- তারা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আড়াই কোটি মানুষ দেশে থাকলে সরকারের যে রসদ ভোগ করত, সেটাও কিন্তু তারা ভোগ করে না। তারা দেশের বাইরে থাকে, দেশের অর্থনীতির ভালো-মন্দে তাদের আসে যায় না। তারা বিদেশের অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। অথচ, আমাদের দেশের কোনো রিপোর্টিংয়ে অভিবাসন বিষয়টায় আসে না।

রাজনীতিতে গণমাধ্যমের যতটা আগ্রহ, সাধারণ মানুষের ততটা নেই। আমি গ্রামে কাজ করছি। এখানে প্রতিটা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ-বিএনপি পন্থী আছে। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি পন্থী হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে নয়; রুটিরুজির আদর্শ থেকে হচ্ছে। কেউ আওয়ামী লীগ করলেও কিছু সুবিধা পায়, বিএনপি করলেও কিছু সুবিধা পায়। এই বাস্তবাতাটা কেউ বলছে না। বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি রুজি কেন্দ্রীক। একইসঙ্গে রাজনীতিও অনেক মানুষের রুজির পথ হয়ে গেছে। এই বাস্তবতা গণমাধ্যমে আসে না, যারা তুলে আনে তাদের গালি দেওয়া হয়।

টিএমএস: মানুষের গণমাধ্যম তাহলে কী?

আফসান চৌধুরী: আমাদের গণমানুষের অর্থনীতি দেখতে হবে। গণমানুষের অর্থনীতি হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি। এই সম্পর্কে খুব কম রিপোর্টিং হয়। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি নিয়ে কথা বলি। আমরা ব্যাংক নিয়ে কথা বলছি, সাধারণ মানুষ তো ব্যাংকের কোনো সুবিধাতেই নেই। অভিবাসী অর্থনীতি বিশাল, কিন্তু এটি সেভাবে উঠে আসছে না। এই বিষয়টা আমার কাছে খুববেশি ধাক্কা লাগছে। আমরা যেন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, কোনটা নিউজ হবে, কোনটা হবে না। আমরা অনুসন্ধানটা কম করছি।

টিএমএস: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গণমাধ্যমের নতুন প্রতিযোগীর ভূমিকায়। যেটা আগে ছিল না। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আফসান চৌধুরী: ফেসবুকে মানুষ মন্তব্য করে ভাবে যে, সবকিছু হয়ে গেল। এ কারণে এটিকে আমি ভালোভাবে দেখি না। একই সঙ্গে বাস্তবতা হলো বেশিরভাগ মানুষ এটা করছে। ফেসবুক থেকে কত শতাংশ মানুষ সরাসরি খবর নেয়- এটা জানতে বিআইজিডির একটা গবেষণা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে ৫ শতাংশ মানুষ এভাবে খবর নেয়। মূলধারার গণমাধ্যম বলতে টেলিভিশন মানুষ দেখে। তবে বিশ্বাস করে কতটা জানি না। পত্রিকা থেকে মানুষ খবর পায় ১৫ শতাংশ। কাগুজে গণমাধ্যম অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। মানে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, তবে জনপ্রিয়তা কমেছে। আবার বেসরকারি টেলিভিশনে আগ্রহ বেশি, তবে সরকারি টেলিভিশন বিটিভিকেও অবিশ্বাস করা হয় না। এসব জায়গায় গবেষণা করা দরকার।  অর্থনৈতিক রিপোর্টিং করতে গিয়ে কোটেশন রিপোর্টিং বেড়ে গেছে। পরিশ্রমবিমুখতা কিছুটা হয়েছে।

টিএমএস: গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী?

আফসান চৌধুরী: এখন অনেকগুলো সেন্সরশিপ আছে। আগে আমরা জানতাম সরকারি সেন্সর। এখন মালিক বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ী সেন্সরশিপ আছ। মালিকের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা আছে, মালিক রিস্ক নেবে না। আবার ট্রেড ইউনিয়ন আছে, সেটাকে তারা রাগাতে চায় না। এখন ভোক্তারা এক ধরনের সেন্সরে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যমে রাজনীতি নিয়ে সংবাদ হয় বেশি।

টিএমএস: গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে?

আফসান চৌধুরী: প্রশিক্ষণ দরকার। অর্থনৈতিক রিপোর্টিং নিয়ে প্রশিক্ষণ দরকার। সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রশিক্ষণ দরকার। আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের যে প্রতিবেদন বের হয়, সেগুলো কীভাবে পাঠ করতে হয় তার প্রশিক্ষণ দরকার। মালিকপক্ষ থেকে এই বিনিয়োগ না হলে উন্নতমানের রিপোর্টিং, উন্নতমানের কলাম— কোনোকিছুই হবে না। তবে আমি মালিকদের যেমন দেখি না, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাংবাদিকদেরও আগ্রহ দেখি না নিজেকে প্রশিক্ষিত করার ব্যাপারে। এখন যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেটা খুবই সনাতনী প্রশিক্ষণ, এটা খুব একটা কাজে লাগবে না।

এখন সারা বিশ্বে উন্নতভাবে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যমকে তথ্য সরবরাহ করার কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। আমাদের গণমাধ্যমের ব্যবহার পাঠনীতি, দর্শননীতিও পাল্টে গেছে। আমরা বেশিক্ষণ একটা জিনিস দেখতে পারি না। অর্থাৎ, বিশাল বিশাল লেখা কেউ পড়ে না। এজন্য প্রশিক্ষণ দরকার। সেটা পত্রিকা নিজে হোক বা পিআইবি হোক প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, সেখানে যে গবেষণা হয়েছে সেগুলো গণমাধ্যমের সঙ্গে শেয়ার করা উচিত। উন্নত রিপোর্টিং হলে রুজিও উন্নত হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কী হচ্ছে সেটা জানা। আমাদের দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত এত বড়, সেটার কোনো রিপোর্টিং নেই। আমাদের দেশে সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে দেয় না, এটি বড় খবর।  অথচ একটা-দুইটা রিপোর্টের পরে লোকে আর পড়বে না। কৃষিতে কী কী নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে এবং কৃষকের কী পরিবর্তন হচ্ছে এটা মানুষ পড়বে। গণমাধ্যমের ভোক্তারা যে আমাদের সমান মেধাবী এটা আমরা মানতে পারি না। এটা আমাদের বড় সমস্যা। উত্তরণ করতে হলে আমাদের উন্নতমানের গণমাধ্যম করতে হবে।

টিএমএস: গণমাধ্যম এখন আয়ের জন্য ক্লিকবেইট জার্নালিজমের দিকে ঝুঁকছে। এর জন্য কন্টেন্টের মানে নজর দেওয়া হচ্ছে না। এটা কি গণমাধ্যমের ক্ষতি করছে না?

আফসান চৌধুরী: অবশ্যই করছে। সবার জন্য গণমাধ্যম- এটা আর নেই। বাজারে যে সবাইকে থাকতে হবে তা তো না। একই ধরনের গণমাধ্যম অনেক এসে ক্ষতি হয়েছে। নতুন নতুন পত্রিকা আসছে এবং কয়েক দিনের মধ্যে সংকটে পড়ে যাচ্ছে। যারা স্পেশালাইজড হবে তারা ভালো করবে। সবার জন্য গণমাধ্যম এখন আর নেই।