গণমাধ্যমকে মূলে ফিরে যেতে হবে

ফরাসিভিত্তিক একটি সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার প্রতিবছর বিশ্বের সবগুলো দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও কাজ পর্যালোচনা করে একটি ফ্রিডম ইনডেক্স তৈরি করে। প্রতিবেদনে কোন দেশে সংবাদপত্র বা প্রেসের স্বাধীনতা কী পর্যায়ে আছে তা তুলে ধরার জন্য র‌্যাংকিং করা হয়। ২০২৪ সালে করা প্রতিবেদনে ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশ দুই ধাপ পিছিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫ নম্বরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র বা মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা ক্রমে নিচের দিকে নামছে অর্থাৎ কমছে।

যত দিন চাচ্ছে তত মানুষের কথা বলার জায়গা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও টেলিভিশনের কথা বলার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রনে কিছু আইন ব্যবহার করা হচ্ছে যেমন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, এর আগে ছিল ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। এগুলো ব্যবহার করে অনেক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাংবাদিকদের হাতকড়া পরানো হয়েছে। এমন বহু উদাহরণ দেয়া যাবে। শুধু সাংবাদিকতার জায়গায় না, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জায়গা আরও বিস্তৃত; সেটা আমাদের সংবিধানের ৩৯ ধারায় উল্লেখ রয়েছে। সেখানে মানুষের ভাব ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা রয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ৩৯ ধারায় বলা আছে। কিন্তু আমরা দেখেছি অনেক বাউলকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জেল জরিমানা হয়েছে। যারা কার্টুন আঁকেন তাদেরও কারাগারে নেওয়া হয়েছে। সেখানে অনেকে মৃত্যুবরণও করেছেন নানান কারণে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্রের মূলকথা হচ্ছে, আমি তোমার সাথে দ্বিমত করতে পারি, কিন্তু তুমি যেন তোমার কথা বলতে পারো সেজন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি। এটা বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছিলেন। ভিন্নমত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রধান জায়গা। গণতন্ত্র হচ্ছে সরকার ব্যবস্থা— এটুকু আমরা জানি, কিন্তু গণতন্ত্র তার চেয়েও বেশি মূল্যবোধের জায়গা। আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মূলকথা হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। ভিন্নমতকে স্বাগত জানানো। কিন্তু আমরা দেখেছি, আমাদের সমাজের মধ্যে, পার্লামেন্টের মধ্যে সর্বত্রই একমুখীকরণ। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেছে, সরকার, রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে এটি ছড়িয়ে গেছে। ফলে মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এর সত্যিকারের কারণও আছে। তাকে জেলে ঢোকানো হচ্ছে, চাকরিতে ক্ষতি করা হচ্ছে, প্রমোশনে সমস্যা করা হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে মানুষ অনিশ্চয়তা, অবিচার— এগুলো হয়তো মুখবুজে সহ্য করে যায়। এগুলো প্রকাশ করতে পারে না। এমন জায়গায় যেখানে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত সেখানে মিরর এশিয়া নামে নতুন একটি অনলাইন যাত্রা করতে যাচ্ছে। এটার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে বিদেশ থেকে পরিচালিত হওয়ায় তাদের কথা বলার সুযোগ বেশি থাকবে। কাজেই তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে, এই ভূখণ্ডের মধ্যে আইন, নানান ধরনের ব্যবস্থা ও চাপপ্রয়োগকারী ব্যবস্থার কারণে আমরা অনেক কথা বলতে পারি না। যেই কথাগুলো আসলে বলা উচিত। বাংলাদেশে যে সীমাহীন দুর্নীতি হচ্ছে। লুণ্ঠন হচ্ছে। বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে। আমাদের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। সিঙ্গাপুরে কানাডাতে সেকেন্ড হোম তৈরি হচ্ছে। এই কথাগুলো এতোটা স্পষ্টভাবে বলার জায়গা নেই দেশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমরা দেখলাম সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এগুলো কিন্তু ভালো লক্ষণ না। ফলে বাংলাদেশের মধ্য থেকে যেহেতু অনেক কথা বলা যাচ্ছে না, তাই মিরর এশিয়ার কাছে আমার একটা আবেদন থাকবে এই কথাগুলো তারা যেন বলে। যেই কথাগুলো বাংলাদেশে বলা যায়, সব পত্রিকায় বলা যায়, টিভিতে বলা যায়, সেই কথাগুলোই যদি মিরর এশিয়া বলতে থাকে তাহলে এটা সাধারণ মানুষের কাছে খুব বেশি আবেদন তৈরি করবে না।

যেই কথা এখান থেকে আইনের কারণে বলা যায় না। তারা যদি সেই কথাগুলো বলে তাহলে সেটি বাড়তি মাত্রা যোগ করবে। তখন তার তাৎপর্যটাও বেশি হবে। আমরা যা জানি, তাই যদি তারা জানায়, তাহলে খুব বেশিদূর যেতে পারবে না। আমরা চাইব, যে কথা আমরা মনখুলে বলতে পারি না, তারা যেন আমাদের সেটা জানায়। সাংবাদিকতার দায়িত্বও সেটি। সরকার অনেকসময় ভুল বোঝে, যে সাংবাদিকরা কেন সমালোচনা করে, কেন সরকারের ভুলত্রুটি বের করে দেখায়। কিন্তু সাংবাদিকতার প্রথম লাইনেই বলা হচ্ছে, পৃথিবীর সমস্ত সরকার মিথ্যা বলে। পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান মানুষের থেকে তথ্য লুকিয়ে রাখে। সাংবাদিকতার কাজই হচ্ছে সেই লুকায়িত তথ্য বের করে দেওয়া, হাটে হাড়ি ভেঙে দেওয়া। এই খবর প্রকাশ করার মধ্যদিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা নয়, সরকার যেন নজর দিতে পারে, ভুলত্রুটির ব্যাপারে যেন ব্যবস্থা নিতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক করা, বার্তা দেয়া।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মত-দ্বিমত, ভিন্নতা, বাংলাদেশে সেটা অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে। একদলীয় একটা পার্টি ক্ষমতায়। সরকারি দল- বিরোধীদল এবং আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র, সব মিলে জায়গাটি কুলষিত হয়ে গেছে। সাংবাদিকদের ভেতর ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাদেরকে শত্রু জ্ঞান করা হচ্ছে। এই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। আমার মনে হয়, মিরর এশিয়া সেই জায়গা নতুন মাত্রা যোগ করবে। যেসব অনলাইন বিদেশ থেকে প্রকাশ হয় তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের পত্রিকা থেকে কপি করে। মিরর এশিয়া যেন কপি-পেস্ট থেকে বেরিয়ে আসে। সত্যিকারের অরিজিনাল মৌলিক তথ্যগুলো আমাদের দেয়। তাদের কাছে আমি আশা করব, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে পুলিৎজার; সাহিত্যে যেমন নোবেল দেওয়া হয়। সেটি কিন্তু দেওয়া হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য। এটি সবচেয়ে বেশি পেয়েছে আমেরিকান পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিকরা। কারণ বেশিরভাগ পুলিৎজার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে ফিন্যান্সিয়াল করাপশনের বা আর্থিক কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য। ওয়াশিংটন পোস্ট সবচেয়ে বেশি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে। মিরর এশিয়ার কাছে আশা করব, এ ধরনের বড় বড় স্ক্যামগুলো বা দুর্নীতি অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমাদের সামনে তুলে ধরবে। পরিবেশ এখন একটা বড় ইস্যু। তারা যেন পরিবেশটা তুলে আনে। বাল্যবিবাহের দিকে তারা যেন নজর দেয়। আমরা দেখছি ধর্মীয় মৌলবাদ বাড়ছে। সেগুলোর দিকে যেন তারা মনোযোগ দেয়। এখানে বই লেখার জন্য হুমায়ুন আজাদ, অভিজ্যিত, দীপনকে মেরে ফেলা হয়েছে। তারা যেহেতু বাইরে আছে, এই বিষয়গুলো তারা বের করে আনতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন, সুন্দরবন, ঢাকা শহরের তাপমাত্রা, এই বিষয়গুলোর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় তারা জোর দিলে ভালো করবে।

সাংবাদিকতার নিরাপত্তা কেবল সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত না। যে সাংবাদিক যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তিনি তার বেতন-ভাতা ঠিকমতো পাচ্ছেন কি-না। সেখানে ওয়েজবোর্ড মানা হচ্ছে কি-না। ওয়েজবোর্ডের বাইরেও যে সুবিধা দেওয়ার কথা সেগুলো দেওয়া হচ্ছে কিনা, সেখানকার কর্মপরিবেশও বিবেচনার বিষয়।

আমরা গত ৭-৮ বছরে বহু সাংবাদিককে বিনা কারণে চাকুরিচ্যুত হতে দেখেছি। বিজ্ঞাপন বা আয় কমে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সেটি করেছে। সাংবাদিক যদি ঠিকমতো বেতন না পায়, সে যদি লিখে বাসায় ঠিকমতো না ফিরতে পারে। এই ধরনের টানাটানির মধ্যে থাকলে তার পক্ষে মনখুলে কাজ করা সম্ভব না। চাকরির নিরাপত্তার মধ্যে তার হেলথ ইনসুরেন্স থাকা দরকার। অনেক দেশে ঝুঁকি ভাতা দেয়া হয়। সেই ধরনের ভাতার ব্যবস্থা করা দরকার। এই পেশাকে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যেতে হলে এই কাজগুলো করতে হবে।

পত্রিকা বা টিভি ভালো চললে মালিকপক্ষ বেতন দেয়। একটু বিপদের মধ্যে পড়লে সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। সেসব সাংবাদিক চাকরি হারাচ্ছে যারা একটু সিনিয়র হয়েছে, অভিজ্ঞ হয়েছে বা বেতন একটু বেশি। তাদেরকে ছাঁটাই করে ইয়াং বা তরুণদের নেওয়া হচ্ছে। একারণে আমি দেখেছি, প্রচুর ভালো ভালো সাংবাদিক বিদেশে সেটেল্ড হয়েছে। অনেক ভালো সাংবাদিক সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে এনজিওতে গেছেন। সাংবাদিকের নিরাপত্তা সংবাদপত্র বা মানুষের চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

তাই মিরর এশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে বা বিদেশ থেকে যাদের দিয়ে কাজ করাবে তারা যেন ঠিকমতো বেতন-ভাতা পায়, একটা মর্যাদাপূর্ণ ওয়েজ তাদের জন্য যেন ধার্য করা হয়। অনন্য হতে হবে। তার জন্য কন্টেন্টে ভালো হতে হবে। যাদেরকে দিয়ে কাজ করানো হবে তাদের ক্রিয়েটিভ ও ইনোভেটিভ নিশ্চিত করতে হবে। এমন লোকবল নেওয়ার জন্য তাকে বাড়তি বিনিয়োগ করতে হবে। এই আকাঙ্ক্ষাটাও মিরর এশিয়ার কাছে থাকবে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।

অনেকে বলছেন, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে কোনো কাগজ থাকবে না। নিউজপেপার থাকবে না, আমি চাই বা না চাই। মিডিয়া কনভারজেন্স তৈরি হচ্ছে। টেলিভিশন, সংবাদপত্র, অনলাইন, অডিও-ভিডিও সবকিছু একটা মাধ্যমে পাওয়া যাবে। সেটা হতে পারে মোবাইল। মোবাইলে একসঙ্গে টিভি, পত্রিকা পাওয়া যাবে। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে মূলধারার সংবাদপত্র, টেলিভিশন কিংবা অনলাইন। ফেসবুকে মানুষ আগেই তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। তারপরেও দিনশেষে এই মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার ওপর মানুষের আস্থা। কারণ ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় গেট কিপিংয়ের ব্যবস্থা নেই। যেকোনো ব্যবহারকারী চাইলে যে কোনো একটা কথা সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই পোস্ট করতে পারে। তথ্যাটি ঠিক কিনা এটি যাচাই করতে হয়। এজন্য আমাদের আবার মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে ফিরে আসতে হয়। আমার কাছে মনে হয়, আস্থার জন্য আমাদের এখনও মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে ফিরে আসতে হয়। কারণ ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেইক জিনিস বা গুজব অনেক বেশি। এখানে মূল জায়গাটা হচ্ছে গেইট কিপিং। এসব মিডিয়াতে এমন কিছু মানুষ থাকে তারা সবকিছু যাচাই না করে খবর ছাপবে না। এই প্রতিযোগিতা থাকবে। তবে বিশ্বাসযোগ্যতা রাখতে পারলে মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে মানুষ ফিরে আসবে।

রোবায়েত ফেরদৌস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক