সরকার সমাজের পাশাপাশি মিডিয়াকে দুই ভাগ করেছে : দিলারা চৌধুরী

গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য গণমাধ্যম দরকার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে মানুষ গুরুত্বের মধ্যে নেয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহু ধরনের মিডিয়া হয়েছে। এখন টিভি চ্যানেল আছে ৪৫টি। বহু নিউজপেপার আছে। তারপরে আবার সোশ্যাল মিডিয়া আছে, নিউজপোর্টাল আছে। মিডিয়া অনেক আছে। এখন যে কেউ একটা কার্ড বের করে বলছে, সে সাংবাদিক এবং এমন একটা পত্রিকার পরিচয় দেবে জীবনে নামটাও শুনিনি। কিন্তু বের করছে তো কাগজ। মিডিয়ার যে ভূমিকা একটি গণতান্ত্রিক দেশে হওয়া উচিত সেটা নেই। বিভিন্ন ইনডেক্স যেমন প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সেও সেটা উঠে এসেছে।

দেশে এখন ৪৫টি টিভি চ্যানেল আছে, ২৮টি এফএম রেডিও আছে, ১২৪৮টি দৈনিক পত্রিকা আছে। এছাড়া শত শত অনলাইন নিউজপোর্টাল আছে। একটা দেশে এতগুলো মিডিয়া থাকলে পলিটিক্যাল কমিউনিকেশন তো খুব ভালো থাকার কথা। সরকারের জবাবদিহিতা, সরকারের কর্মকাণ্ড প্রচার, জনমত তৈরি, জনগণের মতামত সরকারের কাছে তুলে ধরা- গণতান্ত্রিক সমাজে তো মিডিয়া এগুলো করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে মনে হয় যেন মিডিয়া খুব ভাইব্রেন্ট রোল প্লে করছে। তবে প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স বলছে ভিন্ন কথা। প্রেস ফ্রিডম ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে যাচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে বছর বছর প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। সুতরাং, এতগুলো মিডিয়া থাকার পরেও তারা প্রেসের যে রোল সেটা করতে পারছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন করতে পারছে না। মিডিয়ার ওপর কন্ট্রোল মোটামুটি আমাদের মতো সব দেশেই থাকে। যদিও ইউএসএ’তে নেই।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট আইন হয় ১৯৭৪ সালে; বিশেষ ক্ষমতা আইন। সেটা এখনও বলবৎ আছে। কোনো সরকারই এটা মডিফাই করার কথা বলে না। এর মাধ্যমে জামিন ছাড়া পুলিশ ১২০ দিন সাংবাদিকদের জেলে রাখতে পারতো। এই আইনের পরে যে বাংলাদেশে গণমাধ্যম টোটালি কন্ট্রোলে তা কিন্তু নয়। আগে সামাজিক নর্মস ছিল, সরকার সরাসরি ততটা হস্তক্ষেপ করার সাহস পেত না, সিভিল সোসাইটি ছিল; সুতরাং, মিডিয়া মোরাললেস স্বাধীন ছিল। মিডিয়ার কাজও আমরা দেখেছি। ১৯৯১ সালের নির্বাচন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দেখেছি। জাতীয় ইস্যুগুলো মিডিয়ায় উঠে এসেছে। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা, সরকারের কাছে জবাবদিহিতার কথা এই আইন সত্ত্বেও করতে পেরেছে। তবে ভাঙনটা শুরু হয় ২০০৯ সালে।

সিস্টেমেটিক্যালি দেশটাকে ওয়ান পার্টি স্টেটের দিকে নিয়ে যাওয়ার কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালে। তখন বিএনপিও ব্যর্থ হয়েছে। সরকার যে স্টেপ নিচ্ছিল সেটাকে যে আন্দোলন বা জনমত তৈরি করে সরকারকে প্রেশারে নিয়ে আসা, সেটা বিএনপি করতে পারেনি। করতে না পারার কারণও আছে। কারণ বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি সবসময় এদেরকে সাপোর্ট করে এসেছে। তারা যাই করুক সিভিল সোসাইটি সাপোর্ট দিয়েছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারে যাওয়ার পথ সরকার ঠিকই করে নিয়েছিল। যে কোনো সরকারই কর্তৃত্ববাদের দিকে যেতে তিনটি কাজ করে। সিভিল সোসাইটিকে কব্জায় নেয়, প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দেয়, তৃতীয়ত ফিয়ার সাইকোসিস তৈরি করে। এটার জন্য মিডিয়াকে কন্ট্রোল করতে হয়। এই কাজটাই সরকার করেছে। অথোরেটেরিয়ান সরকারের কিছু সহযোগী ফোর্স থাকে। এই সরকারের আছে- ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের মাধ্যমে ফিয়ার সাইকোসিস তৈরির কাজটা করেছে সরকার। তখন পর্যন্ত নতুন আইন হয়নি।

আরেকটা কাজ সরকার করেছে। সমাজকে দুই ভাগ করার পাশাপাশি মিডিয়াকে দুই ভাগ করেছে। এখন সরকারের কোনো কাজ যেটা ঠিক না সেটা একসঙ্গে তুলে ধরার সুযোগ আর নেই। সমাজের মতো জার্নালিস্টদের মোরাল ডিগ্রেডেশন হয়েছে। যে কারণে দেশে জার্নালিস্টরা কাজটা ঠিকমতো করতে পারেনি। এখনও পারছে না। এছাড়া এখন মানুষ খবরের কাগজ, টেলিভিশনের খবরে ঠিকমতো বিশ্বাস করে না।

এখানে ক্রস মিডিয়া ওনারশিপ তৈরি হলো। এর ফলে জবাবদিহিতা থাকলো না। কারণ সরকারই তো অ্যাকাউন্টেবল না। এর ফলে ক্রস মিডিয়া ওনারশিপ থেকে নিজেদের ইন্টারেস্টে কাজ শুরু হলো; মিস ইনফরমেশন বা মানুষকে মিস লিড করা শুরু হলো। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বাংলাদেশের মিডিয়া হাউসগুলো চলে গেছে অলিগার্কদের হাতে চলে গেছে।

সাংবাদিকের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা যে মোরাল দায়িত্ব সেটাই মানুষ ভুলে গেছে। এটা হয়েছে ওনারশিপ অলিগার্কদের হাতে চলে যাওয়ার কারণে। শেষে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ধ্বংস হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কারণে। এটি জিজ্ঞেস করলে সরকার বলবে- সব দেশেই তো আছে। আমাদের দেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা মত প্রকাশের একেবারে বিরুদ্ধে। যে কোনো মত প্রকাশ, সেটা সাংবাদিক-আমি বা যে কেউ। যে কোনো মত প্রকাশের ‍বিরুদ্ধে তারা ৭-১০ বছর জেল দিয়ে দেবে। এখন কে সাহস করে সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করবে। সাংবাদিকরা কি লিখতে পারছে? সরকারের অনিয়ম নিয়ে কিছু লিখতে পারে?

যেমন- বেনজীরের সম্পত্তি নিয়ে সংবাদ করার পরেও মানুষ কালের কণ্ঠকে বাহবা দিচ্ছে না। কারণ নাকি ওদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল; এরপরই কালের কণ্ঠ বেনজীরকে এক্সপোজ করেছে। আমি বলতে চাচ্ছি- যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই সবকিছুর মালিক। তাই জনগণ যেটা চিন্তা করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে যখন অনেক লেখালেখি হলো তখন আবার সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হলো। কিন্তু এটিও সেই একই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই। একটা দেশের সরকারে যেখানে কোনো রকম জবাবদিহিতা থাকে না এবং সেই সরকার খুবই রিগ্রেসিভ, নিজের লেজিটিমেসি তৈরি করার জন্য নানারকম মিস ইনফরমেশন দিচ্ছে সেখানে মিডিয়ার কী রোল থাকতে পারে? আমি বলব বাংলাদেশের মিডিয়া এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে এটাকে কেউ বিশ্বাস করছে না। আবার সোশ্যাল মিডিয়ারও সমস্যা আছে, সেখানে ফেক নিউজ পাওয়া যায়; কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে। এটাকে আবার কাউন্টার করার জন্য সরকারও ফেক তথ্য ছাড়ে। সমাজকে পুরো একটা বিভ্রান্ত করে রাখা হয়েছে। মিডিয়াকে ধুরছাই করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া তথ্য ছেড়ে। আমরা সত্যি জানি না সরকার কী চায়?

সরকার যে আইন করছে এতে আমাদের কোনো ইনপুট নেই। আইন প্রয়োগ করার সময় যে আমাদের সমস্যা হচ্ছে এটা বলারও জায়গা নেই। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি সমাজের বা দেশের শাসনব্যবস্থার চিত্রই প্রতিফলিত করে। আমরা আইয়ুব খানের শাসনামলও দেখেছি। তখন ইত্তেফাকের কী ভাষা! এই যে বসুন্ধরা গ্রুপের বাংলাদেশ প্রতিদিন পড়ে মানুষ কিন্তু বিশ্বাস করে না। এখন মোস্ট মিস ইনফর্মড পিপল বাংলাদেশের মানুষ। এটাতো হেলদি সমাজ হলো না। এখানে সমাজ এমন এক অবস্থায় যাবে যেখান থেকে উঠে আসা যাবে না। সমাজকে ঠিক রাখার দায়িত্বও তো মিডিয়ার। সমাজকে তো মিডিয়া ইনফরমেশন দেবে, সত্য কথাটা বলবে, আমার কথাটা তুলে ধরবে- সেই দায়িত্বটা মিডিয়া পালন করতে পারছে না। এমনটা আরও চলবে। কিন্তু আমরা উঠে আসতে পারব কি-না জানি না।