সরকারের কব্জায় মূলধারার গণমাধ্যম 

এআই জেনারেটেড প্রতীকী ছবি

ফ্রান্সের প্রখ্যাত দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন, ‘আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেব।’ পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে নানা পথ এবং মতের মানুষ এসেছেন, তাদের কথা বলেছেন, জীবনের ঝু্ঁকি নিয়ে তাদের মতবাদ লিখে রেখে গেছেন। প্রখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস যখন যুবসমাজকে আলোর পথের ঠিকানা দিতে থাকলেন তখন গ্রীসের সরকার তাকে মৃত্যুদণ্ড দিল। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও যখন বললেন, সূর্য নয় পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে- তখন রোমের খ্রিস্টধর্মের যাজকরা তার মৃত্যুদণ্ড চাইল। এতবড় একজন বিজ্ঞানীকে তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য জীবন দিতে হবে? তখন বিচারকগণ গ্যালিলিওকে তার গবেষণাকে অস্বীকার করতে বললেন। বিনিময়ে তার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত হবে এবং বাকি জীবন তিনি দ্বীপে নির্বাসনে থাকবেন। সেসময় মত প্রকাশে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা ছিল। তারপরও জ্ঞানী-গুণীদের কল্যাণে আমরা সত্যটা জানতে পারি।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে কী ঘটতে পারে তার একটা তথ্য পাই আধুনিক যুগের অন্যতম গবেষক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি গ্রন্থ ‘হাঙ্গার এন্ড পাবলিক অ্যাকশন’-এ। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সরকার কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করে, সরকার আমলাতন্ত্রের জালে আটকা পড়ে, সর্বত্র ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুব প্রভাবশালী রিপোর্টার ছিলেন না। তাদের কাছে এমন কী তথ্য ছিল যার ভয়ে সরকার তটস্থ ছিল? জানি না। সরকারের ভাবমূর্তি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এমন তথ্য যদি তাদের কাছে থেকেই থাকে তার জন্য তাদের মেরে ফেলতে হবে? তাদের কলম থামানোর বহু পথ খোলা ছিল। ঘাতকের দল সে পথ পরিহার করে তাদের এই নশ্বর পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে চিরতরে বিদায় করে দিল। আর সরকার সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে রহস্যময় আচরণ শুরু করে দিয়েছে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন যেখানে বললেন- ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। একযুগ পার হয়ে গেল, ১০৮ বার তদন্ত পেছানো হলো। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে যাতে পত্রিকাটি সত্য প্রকাশে ইতস্তত করে। সরকারের হাড়ির খবর তুলে আনার দায়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে একশ বছরের পুরনো অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা দেওয়া হয়েছে। বিনা বিচারে তিনি দীর্ঘদিন জেল খাটলেন। চাল ডালের স্বাধীনতা চেয়ে প্লাকার্ডের ছবি সম্বলিত রিপোর্ট লেখার দায়ে হাজতবাস করতে হলো সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল শিক্ষার্থীদের মিছিলে হেলমেট লীগের ছবি তুলে নিজ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় দীর্ঘ দিন জেলের ঘানি টানতে হয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক শহিদুল আলমকে। মাগুরার এক এমপি সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন লেখার কারণে নিখোঁজ হলেন ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। দীর্ঘ এখানে সেখানে চোখ বাধা অবস্থায় রাখার কারণে তিনি কিছুই বলতে পারেন না কোথায় ছিলেন। চোখ যখন খুলে দেওয়া হলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলেন পুলিশের ডেরায়।

আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই সংবাদপত্রকে শত্রু ভাবে। স্বাধীন মত প্রকাশকে সহ্য করতে পারে না। অথচ অনেক বড় বড় ঘটনা তারা ধামাচাপা দিয়ে গেছে একটার পর একটা। হলমার্কের নামে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুট, বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে ১৭ হাজার কোটি টাকা লোপাট, বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ডলার লুটপাট, পিকে হালদারের লুটপাট, ইসলামী ব্যাংক দখল করে ১ লক্ষ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি পরিবার। এখন আইএমএফ-কে এনে রিজার্ভ সামাল দেওয়ার চেষ্টা- এসব কিছু নিয়ে সত্য রিপোর্ট তুলে ধরলেই ডিজিটাল আইনে মামলা। অনেক বেসরকারি ব্যাংক তারল্যের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জোর জবরদস্তি করে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে জুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মন্দ ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু খতিয়ে দেখা হচ্ছে না এসব ব্যাংক কেন দেউলিয়া হয়ে গেল। আবার দুই ব্যাংককে একত্রিত করার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করে দেওয়া হচ্ছে আরেকটি লুটপাট গ্রুপ। 

ভারতের একটি অনলাইন পোর্টালে নিউজ করা হয়েছিল হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ খবরের প্রতিবাদ জানিয়েছে তবে মাঝখান থেকে সাংবাদিকদের ব্যাংকে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পেশাদার সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক তার অবস্থানে অনড়। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘কোন দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাংবাদিকদের প্রবেশ অধিকার আছে?’ সাংবাদিকরা সেন্ট্রাল ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে রিপোর্ট করবে। কিন্তু ওবায়দুল কাদের সাহেব মনে হয় জানেন না- বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট আপডেট থাকে না। থাকলেও সেটা স্বচ্ছ নয়। একই ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন রকম হয় কী করে? বলা হয় গ্রস রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার, আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাব অনুযায়ী সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ১৯ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আর সাংবাদিকরা যখন দেখায় তখন বলা হয় ব্যয়যোগ্য মুদ্রা রিজার্ভ আছে ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে। তারপর বৈদেশিক ঋণের কথা যদি ধরা হয়, সেটা এই মুহূর্তে কত? ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান এ সম্পর্কে একটা বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করা কোনো দোষের নয়, কারণ এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০ বছর পর।’ তার কথাতে স্পষ্ট যতই ঋণ করে সরকার চলুক না কেন এটার দায়ভার সরকারকে নিতে হচ্ছে না। এর দায়ভার নেবে এখান থেকে ২০ বছর পর যে প্রজন্ম আসবে তারা। অর্থাৎ এই সরকার বাংলাদেশকে বন্ধক রেখে যাচ্ছে অন্য দেশের কাছে এবং সেটা ফেরত আনার দায় ২০ বছর পরের প্রজন্মের।

লুটপাটের অর্থনীতির এমন ভঙ্গুর অবস্থার কথা সাংবাদিকরা ছাড়া আর কে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারে? এটা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হাতে চলে যায় তখন বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু নয় সরকারের ত্রাহি অবস্থা সৃষ্টি হবে। সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে অর্থনীতির চিত্র যদি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে তাহলে সরকার ঘাটতিগুলো সংশোধন করে নিতে পারে। সাংবাদিকরা সরকারের শত্রু নয়। একজন ভালো সাংবাদিকের কোন বন্ধু থাকে না। সরকার এই সত্য উপলব্ধি করলে দিনশেষে তাদেরই লাভ। 

এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের সম্পদের পাহাড়। তিনি সারা জীবন পুলিশে চাকরি করেছেন। ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যারা দুর্নীতি করতে চায় তারা যেন পুলিশে না আসে- এমন ঘোষণাও দিয়েছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। এ সম্পদ তিনি একদিনে গড়ে তোলেননি। চাকরিতে থাকা অবস্থায় এবং অবসরে যাওয়ার পর এই সম্পদ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন এবং আরো যে সমস্ত তদন্তকারী সংস্থা রয়েছে তাদের চোখের সামনেই তো বেনজীরের এই সম্পদ গড়ে উঠেছে।

কেউ তো তার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে নাই। বেনজীর যখন চাকরি করেছিলেন তখন কোন সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট করার সাহস দেখাতে পারে নাই। কারণ তিনি ছিলেন ক্ষমতাধর প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে কোন সাংবাদিক রিপোর্ট করলে তাকে যে সাগর-রুনির ভাগ্যবরণ করতে হত না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? তাইতো যখন তিনি অবসরে গেলেন তখন রিপোর্ট করা শুরু হলো- তাও অবশ্য হয় অর্থের ভাগাভাগি নয়তো ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে। সাংবাদিকরাও যে একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা তাও অবশ্য বলা যায় না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক