সব করেও কেন বিজেপির ব্যর্থতা

শাহাদাৎ হোসাইন

২০১৪ ও ২০১৯ সালে ভূমিধ্বস জয় নিয়ে দিল্লির মসনদে বসে হিন্দুত্ববাদি দল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি। পরপর দুবার ক্ষমতায় আরোহণ দলটিকে এত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল যে এবার দলটির শ্লোগান ছিল “এসবার চারশ পার”। অর্থাৎ ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৪০০ আসনে জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার স্বপ্নে বিভোর ছিল দলটি। ২৬ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত কয়েকটি ধাপে চলা এই নির্বাচনের শুরুতেই ধাক্কা খায় বিজেপি। এপ্রিল থেকে বুথফেরত নানা জরিপ বলছিল- বিজেপির ৪০০ পার করার স্বপ্ন আদতে পূরণ হবে না। তবে, ১ জুন শেষ দফা নির্বাচনের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে বুথফেরত জরিপে বিজেপি ৪০০-এর কাছাকাছি আসন দেওয়া হয়। যদিও বিজেপিঘেঁষা এসব গণমাধ্যমের জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

সমস্ত সমীকরণ ব্যর্থ করে দিয়ে মঙ্গলবার (৪ জুন) সকাল থেকে এক ভিন্ন ফলাফলের খবর আসতে শুরু করে। ৪০০ পার তো দূরে থাক, বরং বিজেপি এবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পাচ্ছে না। সরকার গঠন করতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ’র ওপর নির্ভর করতে হবে।

এবারের নির্বাচনে বিজেপি শুধু আত্মবিশ্বাসী ছিল তা নয়, এমন কোনো কৌশল অবলম্বন বাকি রাখেনি জেতার জন্য। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হলো, কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজড করা হলো, মুসলিমদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ অযোগ্য ঘৃণামূলক বাক্য ছড়ানো হলো। গণমাধ্যমে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ যেমন নেওয়া হলো, তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হলো বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। 

বিজেপির এসব পলিসি বরং দলটির জন্য বুমেরাং। এভাবে বিরোধী মতের ওপর উঠেপড়ে লাগাতে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার প্রেরণা পেয়েছে। কেন্দ্রে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস জোটবদ্ধ হলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে তাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরী ও মমতা ব্যানার্জির দ্বন্দ্ব ঘিরে রাজনীতি ঘোলাটে হলে কেন্দ্রে থেকে চৌধুরীকে সতর্ক করা হয়। এই থেকে বোঝা যায় কোনো কিছুর বিনিময়ে বিরোধীদের ঐক্যকে বিসর্জন দিতে চায় না রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস। 

বিজেপির রামমন্দির ইস্যু
 
উত্তর ভারতের শ্রী রামকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বলে পূজা করা হয়। তাই এবারের নির্বাচনে বিজেপি বেশ তড়িঘড়ি করে রাম মন্দির উদ্বোধন করে। সেখানে সমস্ত ফোকাস দেওয়া হয় নরেন্দ্র মোদির ওপর। এমনকি বিজেপির অন্য নেতা বা ভারতের রাষ্ট্রপতি উপস্থিতি ছিলেন না। কংগ্রেস আমলে নয়াদিল্লিতে অক্ষরধাম মন্দির উদ্বোধন করা হয়েছিল। উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন ভারতের শিখ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং মুসলিম রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। কিন্তু বিজেপি ভারতের বহুত্ববাদকে দূরে ঠেলে দিয়ে ‘হিন্দু, হিন্দি ও হিন্দুত্ববাদ’কে ভারতের একমাত্র পরিচয় হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টায় আছে। 

অন্যদিকে, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে জনগণের অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। সে আগুনে ঘি ঢেলেছে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সরা। রাবিশ কুমার ও ধ্রুব রাঠির মতো জনপ্রিয় ইউটিউবাররা সাধারণ হিন্দি ভাষায় তুলে ধরেছে দেশের সংকট! তারা বিজেপির অনেক প্রপাগান্ডার জবাব দিয়েছে। এসব বিষয় ঘুরিয়ে দিয়েছে সমীকরণ। মানুষ বাস্তব সংকটকে আমলে নিয়ে ভোট দিয়েছে।

উত্তর প্রদেশে ধরাশায়ী বিজেপি

৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে উত্তর প্রদেশে ৮০টি লোকসভা আসন রয়েছে। ফলে ভারতের রাজনীতিতে একটা কথা আছে, “লখনউ যুসকা, দিল্লি উসকা’। ২০১৪ সালে উত্তর প্রদেশে বিজেপি ৮০টি আসনের মধ্যে ৭১টি ও ২০১৯ সালে ৬৩টি আসন পেয়েছিল। এবার বিজেপি দাবি করে আসছিল তারা ৮০টির ৮০টি আসনই জিতে নেবে। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচন কংগ্রেসের ফলাফল অনুযায়ী উত্তর প্রদেশে অভূতপূর্ব ভালো ফল করেছে কংগ্রেস মিত্র অখিলেশ যাদবের সমাজবাদি পার্টি। তারা প্রায় ৩০টি আসনে এবং কংগ্রেস প্রায় ১০টি আসনে এগিয়ে আছে। বিজেপির ঘাঁটি বলে পরিচিত উত্তর প্রদেশে বিজেপির এমন ধরাশায়ী হওয়ার কারণে বিজেপি এখন সরকার গঠন করতে চাইলে তাকাতে হবে বিহার ও অন্ধ্র প্রদেশের দিকে। বিজেপির জোটসঙ্গী বিহারের নীতিশ কুমারের দল জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) এবং অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবুর নাইডুর তেলেগু দেশম স্ব-স্ব রাজ্যে এগিয়ে আছে। একমাত্র তারাই পারে বিজেপির পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মসৃণ করতে।

চলবে....

লেখক: সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সি নয়াদিল্লির রিসার্চ স্কলার