মানুষকে চাপে রাখার বাজেট

প্রতীকী ছবি/দ্য মিরর এশিয়া

নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন জাতীয় সংসদে। অর্থমন্ত্রী বলছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংকোচনমূলক। এই বাজেট সংকোচনমূলক না করেও কোনো উপায় ছিল না। আইএমএফের চাপ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পরস্পর নির্ভরশীল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাজেটের আকার ছোট রাখা প্রয়োজন ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা কম থাকার কারণে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আমদানি না হলেও রিজার্ভ বাড়ছে না, রিজার্ভ না বাড়লে সংকটের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের ত্রাহি অবস্থা। সবকিছু মিলে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার নামে এবার সংকোচনমূলক বাজেট করা হয়েছে।

আপাতত শুনতে ভালো মনে হলেও এই বাজেটের উদ্দেশ্য এবং বিধেয়ের মধ্যে ব্যাপক ফারাক রয়েছে। বলা হয়েছে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হবে। এবারের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য এটি। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও বলা হয়েছিল এবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করাই সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ। শুধুমাত্র বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬-৬.৫ শতাংশে নিয়ে আসবো বললেই সেটা হয়ে যায় না। বাজারে এখন মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৯-১০ শতাংশ। সেটাকে ৬ শতাংশে আনার জন্য যে পদক্ষেপ বা কৌশল প্রয়োজন তা বাজেটের মধ্যে থাকতে হবে।

বাজেটটি সম্পূর্ণরূপে পরোক্ষ কর নির্ভরশীল। প্রত্যক্ষ কর এখানে খুব একটা নেই। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর, আদায় করার বা ব্যবস্থাপনা উন্নত করার কোনো লক্ষণ এখানে নেই। মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট, ভ্রমণ আরও অনেক কিছুতে পরোক্ষ কর বাড়ানো হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় কমানো হয়েছে, কিন্তু সেটি ততটা কাজের নয়। বরং বলা যায় লোক দেখানো হ্রাস। শিশু খাদ্য গুঁড়া দুধ, অন্যান্য নিত্যপণ্যে যে শুল্ক কমানোর কথা বলা হয়েছে তা আদতে কতটুকু কার্যকর হবে তা কারো অজানা নয়। দেশে দাম বাড়লে সেটি আর কমে না, এটি সর্বজনবিদিত। ফলে এই ধরনের কিছু পণ্যে শুল্ক কমিয়ে মানুষকে দেখানো হয় যে, আমরা এখানে এখানে দাম কমিয়ে দিলাম। আদতে তা বাস্তবায়িত হয় না। 

ভোজ্য তেলের ওপর শুল্ক কমানোর যে কথা বলা হচ্ছে তার আসল উদ্দেশ্য দাম কমানো। কিন্তু আসলে কি দাম কমে? সে ধরনের বাজার ব্যবস্থাপনা কি রয়েছে? এক কথায় নেই। শুল্ক বাড়ানো হয়েছে এমন সব জায়গাগুলোতে যা মানুষকে স্পর্শ করবে। যে জায়গাগুলোতে দাম বাড়লে মানুষের দৈনন্দিন খরচের ওপর চাপ পড়বে। অর্থাৎ দ্রব্যমূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়বে। যেমন, মোবাইল সেবা বা ইন্টারনেটে কর বাড়ানো। এটা সকল মানুষের ওপর প্রভাব পড়বে। অথচ এই মোবাইল ব্যবহার, ইন্টারনেট বা প্রযুক্তি অর্থনীতিকে অনেক গতিশীল করেছে। মানুষ সহজেই টাকা পয়সা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠাতে পারছেন, অনেকে ফ্রিল্যান্সিং করছে, প্রযুক্তি সংস্পর্শে মানুষের অনেক কাজ সহজ হয়েছে। সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর কর আরোপ করলে সম্ভাবনাময় এ খাতের ওপর থেকে মানুষের আগ্রহ কমে যাবে। 

মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলা হয়েছে, কতটুকু কমানো হবে সেটি বলা হয়েছে। কিন্তু কোন উপায়ে কমানো হবে সেই উপায়গুলো স্পষ্ট করা হলো না। মূল্যস্ফীতি কিভাবে ৬ শতাংশের মধ্যে আনা সম্ভব হবে এখানে তা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। 

করের আওতা বাড়ানোটা দরকার। কিন্তু সেখানে কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বরং আরও সংকুচিত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দেওয়া হয়েছে ১৫ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে। এর ফলে সাধারণ কর দাতারা নিরুৎসাহিত বোধ করবেন। যারা কালো টাকা সাদা করবেন তাদের ৩০ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে না, কোনো পেনাল্টি দিতে হচ্ছে না, বরং শুধুমাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়েই মাফ পেয়ে যাচ্ছেন এবং টাকা সাদা করে ফেলতে পারছেন। সব থেকে বড় কথা তাদেরকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এটা একটি অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিক ঘোষণা। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বলা হয়েছিল, ট্রুথ কমিশনে গেলে কিছু বলা হবে না। মানুষ সাদা মনে সেখানে গেল এবং পরে দেখা গেল ট্রুথ কমিশনে যাওয়াটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখানেও বলা হচ্ছে কালো টাকা সাদা করতে গেলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন না করে ছেড়ে দেওয়া কিভাবে সম্ভব! কোথাও না কোথাও এই টাকা ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহার করতে গেলে বলতে হবে এই টাকা কোথা থেকে পেয়েছেন। 

প্রশ্ন করা হবে না মানে কি পি কে হালদারের মতো ব্যক্তিদেরকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে? কালো টাকা সাদা করতে প্রশ্ন করা না হলে তার মানে দাঁড়াবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া। দুর্নীতি করতে আরো উৎসাহ পাবে তারা। এর থেকে সমাজে এমন একটি ধারণা জন্মাবে যে, যত পারো কালো টাকা উপার্জন করো কোনো ভয় নেই। 

প্রত্যেকটা জায়গায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে স্পষ্ট ঘোষণা এবং পদক্ষেপ দেখাতে হবে। তাহলেই কেবল এই বাজেট ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। এনবিআরের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে তা পাটিগণিতের নিয়ম অনুযায়ী। গত বছরের তুলনায় ১৩ বা ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজস্ববহির্ভূত আয় এবং করবহির্ভূত আয় অর্থাৎ সরকার মালিকানাধীন সেবামূলক কোম্পানিগুলোর আয়ের বিষয়ে কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোকে আয় বাড়ানোর কোনো লক্ষ্যমাত্রা না দিয়ে বরং কমানো হচ্ছে। 

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান