বেনজির নাটকের আপাত অবসান?

ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল। দেশ থেকে সপরিবারে পালিয়ে যাওয়া বেনজির এখন তুরস্কের নাগরিক। আর স্ত্রী জিসান মীর্জার নামে সেকেন্ড হোম রয়েছে স্পেনে। বেনজির পরিবার এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাত্র ৫ কোটি টাকা দিয়ে নাগরিকত্ব কিনেছেন তুরস্কে। এখন তিনি আর বাংলাদেশের নাগরিক নন। এখন দুদক কীভাবে বিচারের কাঠগড়ায় আনবে এই দুর্দান্ত চালাক বেনজিরকে?

বেনজির যে একজন পাক্কা খেলোয়াড় সেটা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। পুলিশের চাকরিতে ঢুকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, তাকে টাকা বানাতে হবে, অঢেল জমি-জমা বানাতে হবে। সেজন্য কখনো সরকারি পাসপোর্ট বানাননি। ব্যক্তিগত পাসপোর্ট দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। এগুলো যে ভয়ংকর অপরাধ সেটা তিনি জেনে শুনে বুঝে শুরু থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছেন। বিদেশ ভ্রমণ করেছেন ব্যক্তিগত পাসপোর্টে। যেটা ঘোরতর অপরাধ। কিন্তু কখনো তাকে এই অপরাধের জন্য কোথাও জবাবদিহি করতে হয়নি। কারণ ভয়ংকর প্রতাপ ও প্রভাবশালী হওয়ায় কখনো কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তোলেনি তার সম্পর্কে।

এমন ভয়ঙ্কর অপরাধের আড়ালে তিনি কী পরিমান নগদ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন তার কোনো হিসাব-কিতাব কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। ফলে দেশের ভেতর তার যে সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি আছে সেগুলো যদি বাংলাদেশে বাজেয়াপ্ত হয়েও যায় তাতে কী আসে যায় বেনজিরের?

গত ৩১ মার্চ ও পহেলা এপ্রিল দুইদিন ধারাবাহিকভাবে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় যে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে তাতে গোপালগঞ্জ মাদারীপুর, গাজীপুরে ১৪শ' থেকে ১৫শ' বিঘা জমির একটা তথ্য পাওয়া গেছে। বসুন্ধরা, গুলশান, উত্তরা এবং বাড্ডায় স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির খবর পাওয়া গেছে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পরে। এখন একে একে সম্পদের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়েও তিনি শত শত বিঘা জায়গা কিনে রেখেছেন, বাগানবাড়ি করেছেন, খামার করেছেন, রিসোর্ট বানিয়েছেন। শোনা যায়, সাতক্ষীরায় শ্বশুরবাড়িতেও রয়েছে তার অঢেল সম্পত্তি। এখানেও শালা-শালীদের নামে রয়েছে ঘের। জেলায় জেলায় রয়েছে তার জমি ও রিসোর্ট। শুরুতে দুদক তদন্তে নেমে ঢাকা, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে অন্তত ৬২১ বিঘা জমির সন্ধান পায় বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের। এরপর গাজীপুর, কক্সবাজার, বান্দরবানেও মিলেছে বেনজীরের জমির সন্ধান। এমনকি কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনস দ্বীপেও জমি কিনে রেখেছেন বেনজীর। 

তার মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের মতো জমিপ্রেম রয়েছে। ব্যাংক, পুঁজিবাজারে ছড়িয়ে রেখেছিলেন অর্থ। সম্পদ জব্দ করার আঁচ পেয়ে আগেই সরিয়ে নিয়েছেন অনেক অর্থ। এখন তার সব হিসাব ফাঁকা। মাত্র পনেরোটা এফডিআর ভাঙ্গিয়ে ৬০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই জানে না। আপনি ৫ লাখ টাকা তুলতে গেলেই আপনার হিসাবের খাতায় টিকটিক আওয়াজ উঠবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আপনার ব্যাপারে খুব স্পর্শকাতর। কেন সেখানে সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ সেটা একটু ভেবে দেখুন। দুষ্টু লোকেরা বলে থাকেন বেনজির যে পরিমাণ টাকা-পয়সা বিদেশে জমিয়েছেন তাতে তার বাংলাদেশের টাকা-পয়সা না হলেও চলবে। বাংলাদেশকে এখন টাটা বাই বাই জানালে তার কিছুই আসে যায় না। এখন তুরস্কের নাগরিক হয়ে ইউরোপের দেশে দেশে ভ্রমণ করে বেড়াবেন তিনি সহপরিবারে। কিছুদিন এমনি আনন্দ ভ্রমণে কাটাতে পারলে এক সময় বাংলাদেশের মানুষ তার সব অপরাধের কথা ভুলে যাবে। এমনকি বেনজির নামটিও হয়তো ভুলে যাবে। আওয়ামী লীগ যবে থেকে ক্ষমতায় এসেছে তবে থেকে এমন কত বড় বড় ইস্যু সৃষ্টি হয়েছে, আবার কয়েকদিন পর সবাই সব ভুলে গেছে। এখন কয়েকদিন তাকে নিয়ে অনেক শোরগোল হচ্ছে, আরো হয়তো হবে। তারপর একদিন সব থেমে যাবে।

বেনজির কে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে ৩১ মার্চ থেকে। কিন্তু সরকারের কিংবা দুদকের কোনো নড়াচড়া ছিল না। অনেক ধাক্কাধাক্কির পর মে মাসে এসে আদালতের শরণাপন্ন হয় দুদক। জারি হয় স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ করার আদেশ। এরপর তার জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে  ৬ জুন তলব করে দুদক। একই অভিযোগে ৯ জুন তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের হাজির হননি, আইনজীবীর মাধ্যমে বাড়তি সময় চেয়ে আবেদন করেছেন। কেউ বলছেন তিনি সিঙ্গাপুরে আছেন। আবার কেউ বলছেন দুবাইয়ে। তুরস্কেও থাকতে পারেন তিনি। 

ঠিক এমন পরিস্থিতিতে ওবায়দুল কাদের কীভাবে তুরস্কের এই নাগরিককে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন বিদেশে যেতে তার কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তাহলে কেন তিনি বিদেশে যাবেন না? একটা চমৎকার পাতানো খেলা- এটা সরকারি মহল থেকে জনগণের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হলো।

একমাত্র ভারত ছাড়া বাংলাদেশের  আর কোনো দেশের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই। কেবল ভারত থেকেই বন্দি বাংলাদেশী নাগরিককে ফেরত আনা সম্ভব। আর অন্য কোনো দেশ থেকে বাংলাদেশের নাগরিককে বিচারের আওতায় আনা যায় না। তার ওপর বেনজীর তুরস্কের নাগরিক, তাকে দেশে আনা এখন অলীক স্বপ্ন। বেনজিরকে যারা এই সুযোগ করে দিয়েছেন আগে তাদেরকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার। বেনজিরের যত পাপ, যত অপরাধ- তার সব দায় এই সরকারের। বেনজিরকে মাফিয়া হতে সাহায্য করেছে এই সরকার, এর দায় নিতে হবেই সরকারকে।

বেনজিরকে দিয়ে লাভবান হয়েছে কে? ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামকে গভীর রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে উচ্ছেদ করার জন্য জীবন-মরণ পদক্ষেপ নিয়েছিল কে? একই বছর ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ ঢাকা শহরে বিরোধীদলের কর্মসূচির দিনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের বাড়ির সামনে বালির ট্রাক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা রচনা করেছিল কে? সেদিন সারাদেশ থেকে যে কর্মী বাহিনী ঢাকা এসেছিল তাদের সমবেত হওয়ার পথ রুদ্ধ করেছিল কে? এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনা ভোটের নির্বাচন সম্পন্ন করার মাস্টার মাইন্ড ছিল কে? যদি কেউ জানতে চায় ২০১৪ সালের যে সরকার গঠিত হয়েছিল তার জন্মদাতা কে? ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি'র পক্ষ থেকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করার জন্য বেগম খালেদা জিয়া যখন তার গুলশানের অফিস থেকে বের হওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তখন তাকে আটকালো কে? এরই ধারাবাহিকতায় যখন অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হল তখন সেই কর্মসূচি ভণ্ডুল করার জন্য একক দায়িত্ব পালন করেছিল কে? কার জন্য শেখ হাসিনার অবৈধ সরকার দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারল? এসব প্রশ্নের জবাব একটাই, আর তা হলো বেনজির, বেনজীর এবং বেনজির।

বেনজির কোনো ব্যক্তি বেনজীর নন, তিনি একটি বাহিনীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ ধারণ করেছিলেন। তিনি জনমনে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তিনিই সরকার। তিনি সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। যে কারণে যত অপরাধই তিনি করে থাকুন না কেন, সরকার সেটা দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে। কারণ সরকার তাকে দিয়ে অনেক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। ফলে তাকে তো কিছু অনৈতিক সুবিধা দিতেই হবে। এভাবেই হয়েছে অপরাধের ভাগাভাগি। এখন শুধু বেনজিরকেই আদালতে হাজির করলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। যে অপরাধে বেনজিরকে আদালতের টানা হচ্ছে সেই একই অপরাধে এই সরকারকেও আদালতে দাঁড়াতে হবে। আজ হোক কাল হোক, বিচার যেহেতু শুরু হয়ে গেছে এর একটা পরিণতি অবশ্যই হবে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বেনজির আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল তখন কিন্তু সরকার তার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে নাই। এমন একটা ভাব দেখানো হলো নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু পৃথিবীর আর সব দেশ তো অবাধে চলাফেরা করা যাবে। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলো বেনজির। প্রতিটা ক্ষেত্রেই সরকারের আশীর্বাদের হাত ছিল তার মাথার ওপর। এখন সে হাত সরিয়ে নিলেও সরকার কি অপরাধের দায় থেকে মুক্তি পাবে?

আর সরকার কি আসলেই বেনজিরের মাথার ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে? নাকি আপাতত বেনজির নাটকের অবসান ঘটানোর জন্য টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা হলো?

 

--