উপমহাদেশে গণমাধ্যম

গণমাধ্যমের ক্যানভাস অনেক বৃহৎ। তাই এটাকে ভারতীয় উপমহাদেশে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এ পরিসরও নেহায়ত সীমিত নয়। তাই সম্ভব নয় ব্যাপক ভিত্তিক আলোচনা। এখানে বলা যেতে পারে, ভারতে ইউরোপীয়দের আগমনের আগে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গণমাধ্যম ছিল না। শাসকের আজ্ঞা ঢোল-বাদ্য, কাড়া-নাকাড়ার মাধ্যমে জন সমাগমের স্থানে জানিয়ে দেওয়া হতো। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা, প্রযুক্তি এবং এগুলোর প্রয়োগও খুব বেশি দিনকার কথা নয়। এমনকি প্রথম ছাপাখানা ১৫৫৫ সনে পর্তুগিজরা গোয়ায় স্থাপন করে। আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে ১৭৮০ সনে জেমস হিকির হাত ধরে কলকাতা থেকে দি বেঙ্গল গেজেট নামক উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের সূচনা হয়েছিল। উল্লেখ্য সে সময়ে এ ধরনের প্রকাশনার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ ছিল। ১৮৫৭ সন এ উপমহাদেশের সংবাদপত্র প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। তখন ভারতীয় ও ব্রিটিশ প্রেসের দু’টো পৃথক কিন্তু সমান্তরাল ধারায় উন্নয়ন শুরু হয়। ১৮৭৬ সনে জারি করা হয় ভার্নাকুলার প্রেস এ্যাক্ট। ব্রিটিশ জামানায় কলকাতার ন্যায় তখনকার অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানে পত্রপত্রিকা প্রকাশের একটি ঢেউ আসে। এর অনেকগুলোই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখে চলে। এক পর্যায়ে মুসলমানদের মাঝে একটি পৃথক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটলে এদের মুখপাত্র হিসেবেও বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। আজকের বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সূচনা হয় অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে। ঐ সময়ে বেঙ্গল রেনেসাঁর ধারক ও সুফলভোগী হিন্দু সমাজের পাশাপাশি মুসলমানদের একটি আলোকিত অংশ সংবাদপত্র প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। গণমাধ্যম হিসেবে গ্রামোফোন রেকর্ড ও চলচ্চিত্র সামনে আসে ব্রিটিশ শাসনকালে। ১৮৯০ সনে ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনির বেতার যন্ত্র আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের পাশাপাশি রেডিও গণমাধ্যমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে প্রসারিত হতে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার ঘটতে থাকে দ্রুত। আসে টেলিভিশন ও ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের হাত ধরেই আমরা পেয়ে যায় ই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদি মাধ্যম। উল্লেখ্য করা প্রাসঙ্গিক যে, ভূ-উপগ্রহ ও সাবমেরিন ক্যাবল সিস্টেম এখনকার গণমাধ্যম বিকাশে প্রধান ভূমিকা রাখছে। ৪০ দশক থেকে সংবাদপত্র হয়ে যায় একটি শিল্প। আজকের উপমহাদেশের ৩টি দেশে এই অবস্থানটি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে।

 গণমাধ্যম বিকাশের এক একটি অধ্যায় অপরটিকে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক না করলেও ফেলে দিচ্ছে চাপে। যেমন রেডিও এখন অনেকটাই লড়ছে অস্তিত্বের জন্যে। সংবাদপত্র অনলাইন এডিশন প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে। আজকের ৬০ ঊর্ধ্বরা যেমন এখনও ছাপা সংবাদপত্রের ওপরই অনেকটা নির্ভরশীল, তেমনি তরুণ প্রজন্ম দ্রুত অনলাইনে কিছু নাড়াচড়া করেই সংবাদপত্র পাঠ করার কাজটি করছে। অধিক মনোযোগী হচ্ছে ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ ইত্যাদি মাধ্যমে। তবে নিত্যকার নির্ভরযোগ্য খবর জানতে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের তেমন বিকল্প এখনও দেখা যায় না। অন্যদিকে সচিত্র ও তড়িৎ খবরের জন্যে টেলিভিশনের আবেদন সংবাদপত্রের চেয়ে বেশি এতে সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে সংবাদপত্র শিল্পকে টিকে থাকতে হলে অনলাইন সংস্করণের দিকে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। এত সব কথার শেষে বলতে হয় যে কোনো প্রকৃতিতেই হোক না কেন মানুষ তার আশেপাশে এমনকি এ গ্রহটির কোথায় কী ঘটছে সেটা জানতে ইচ্ছুক থাকবে। সে জানার প্রয়োজনীয়তা শেষ হবে না। তবে কত দ্রুত, নির্ভরযোগ্য ও বিষদভাদে তা জানা যায় তার ওপর নির্ভর করবে কোন শ্রেণী বা মাধ্যম টিকবে ও কার্যকর থাকবে। মোদ্দাকথা, তাদেরকে জনগণের প্রত্যাশার সাথে তাল রেখে উন্নততর প্রযুক্তির দিকে চলমান থাকতেই হবে। গণমাধ্যম শুধু বিনোদন বা শখের জিনিস নয়। নিত্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধূলা সহ অনেক কাজেই আমরা গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল।

 গণমাধ্যম আমাদের বিভিন্ন খবরাদি দেয়। এতে আমরা চলমান অবস্থা সম্পর্কে হালনাগাদ থাকি। এর বিকল্প কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। এর মাধ্যমে আমরা শিখতেও পারি। যে জিনিস আমরা জানি না বা শুনিনি তা এখনকার কোনো না কোনো গণমাধ্যম অনেকটাই নিখুঁতভাবে পরিবেশন করছে। এর উন্নতির কোনো সীমা নির্দিষ্ট করা যাবে না। চলমান বিশ্ব ও প্রযুক্তির সাথে তাল রেখে এদেরও চলতে হবে। কিছু অসত্য বা একপেশে তথ্য যুগে যুগে অনেক অনিষ্ঠের কারণ ঘটিয়েছে। এখনও এমনটা আদৌও ঘটছে না, এমনও বলা যাবে না। তবে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় প্রকৃত সত্যকে জানতে আমরা একাধিক মাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে পারি। আর এই অবস্থা চলমান থাকবে। বিশেষ করে বর্তমান গণমাধ্যম জগৎ যেভাবে বৃহৎ উদ্যোক্তা বা শিল্পপতিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, সে অবস্থায় আমাদের আরও সর্তক থাকতে হবে।

এখন দেখা যেতে পারে গণমাধ্যমের ওপর সরকারের প্রভাব ও ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত আর এ উপমহাদেশের কী হচ্ছে। গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন, বিচার ও আইন বিভাগ ৩টি স্তম্ভ। এগুলোকে শক্তিশালী ও পরস্পরের প্রতি ভারসাম্যপূর্ণ রাখার ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে দেশটির গণতন্ত্রের ভিত কতটা শক্তিশালী হবে। তেমনি আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে- স্বাধীন, দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী মাধ্যম কোনো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। অন্য ৩টি অঙ্গের পরিপূরক ভূমিকাও গণমাধ্যমের থাকে। চলমান বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ, এগুলোর নির্মোহ বিশ্লেষণ, রাষ্ট্রীয় পদাধিকারীদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সতত জনগণকে অবগত করছে এগুলো। এতে সহজতর হয় অন্য স্তম্ভগুলোর দায়িত্ব সম্পাদন। দেখা যাচ্ছে, বেশকিছু ক্ষেত্রে গণমাধ্যম পক্ষপাতসুলভ আচরণ করছে। এমনটা শুধু গণতন্ত্রের ঘাটতির জন্যই হয় তেমন বলা যাবে না। বিষয়টি আমরা লক্ষ্য করি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বেশ কিছু দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকায়। ইসরাইলের ফিলিস্তিনে অমানবিক ও অযৌক্তিক আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই সেসব গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে আসে না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষ্য করা যায় বিপরীতধর্মী প্রতিবেদনও। গণমাধ্যমের মালিকানায় ক্রমান্বয়ে কর্পোরেট পুঁজির নিরঙ্কুশ প্রভাবে এমনটা ঘটতে পারে। ব্রিটিশ শাসনামলে এ উপমহাদেশে একমাত্র ইলেক্ট্রনিক্স মাধ্যম রেডিওর মালিকানা ছিল সরকারের হাতে। আর সংবাদপত্রের মালিকানা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কেন্দ্রিক হলেও তখনকার শাসকদের মর্জির ওপর নির্ভরশীলতা কম ছিল না। পরে এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও ১৯৪৭ সনে দেশভাগের পর ভারতে বেশকিছুটা উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির শাসকদের কল্যাণে একটি নিরপেক্ষ গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটতে থাকে। অন্য দিকে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী অনেকটাই ছিল অসহিষ্ণু। অন্যদিকে ১৯৫৮ সনে জারি হয় সামরিক শাসন। এসবের প্রভাব তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের ওপর ব্যাপক চাপ ফেলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে আশা করা হয়েছিল, গণমাধ্যমের বিষয়ে আমাদের স্বাধীনতার চেতনা অনুসৃত হবে। সূচনায় এমনটা লক্ষ্য করা গেলেও আমাদের সৌভাগ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সরকার বিরোধীরাও ক্ষেত্র বিশেষে ছিল দায়িত্বহীন। অন্যদিকে শাসক মহলেও লক্ষ্যণীয় হয় অদূরদর্শিতা। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের পর কার্যত টুটি চেপে ধরা হয় গণমাধ্যমের। অন্যদিকে ভারতেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে উদার গণতান্ত্রিক সরকার ছিল না। জরুরি অবস্থা সহ অনেক কারণে পত্রপত্রিকা বন্ধ ও সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটতে থাকে। তবে তারা ব্যবস্থাটি এক পর্যায়ে ফিরিয়ে এনেছিল। বাংলাদেশেও তা হয় ১৯৯১ সনে নির্বাচনের মাধ্যমে। অন্যদিকে টেলিভিশন উপমহাদেশের ৩টি দেশেই নিরঙ্কুশ সরকারের মালিকানায় ছিল। একপর্যায়ে সর্বত্র সংবাদের প্রকাশনা সংক্রান্ত নিয়মাদিও সহজ করা হয়। ব্যক্তি মালিকানায় বহু সংখ্যক টিভি চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করে। আশা করা হয়েছিল, সংবাদপত্রসহ ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় তথ্য প্রবাহ অনেকাংশেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে।

অন্যদিকে আমরা অতি দ্রুতই হতাশ হতে শুরু করি। এমনকি অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগের ফসল ইন্টারনেট সমপর্যায়ের প্রযুক্তি চালু হবার পরও হতাশা দূরীভূত হবে তেমন কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জাতীয় ব্যবস্থাদি অপপ্রয়োগে শিল্পটি চাপে রয়েছে। অন্যদিকে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মালিকানায় বেশকিছু সংবাদপত্রে চলে গেছে। তাদের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় ইলেক্ট্রনিকের মাধ্যমে। এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই চাপ, ভয় ও ক্ষেত্র বিশেষে লোভের বশবর্তী হয়ে অনেকটাই একতরফাভাবে সরকারি প্রচার মাধ্যমের কাজ করছে। অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগ চালু হলেও আমরা ভালোভাবে এটা ব্যবহার করতে পারছি না। এখানেও রয়েছে আইনি নিপীড়নের ভয়। আবার রয়েছে সরকারের পক্ষে থেকে সুবিধাদি পাবার প্রলোভন। অন্যদিকে প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে গুজব রটানোর অপপ্রয়াস আমরা লক্ষ্য করছি। ভারতে আমাদের চেয়ে কিছুটা উন্নত পরিবেশ থাকলেও সাম্প্রতিককালে অনেকটা একই রুপ নিয়েছে। আর পাকিস্তানের অবস্থাও বরাবরের ন্যায় নিম্নতর থেকে যাচ্ছে। এসবের মাঝেও আমরা গণমাধ্যম জগতের সহায়ক হিসেবে তথ্য অধিকার আইনটি পেয়েছি। প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা অথবা ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি বিশেষের অনীহা আইনের মাধ্যমে পুরো তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত না করলেও উন্মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে।

 এত কিছু আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল এদেশে আধুনিক গণমাধ্যমের সূচনা, বিকাশ, বিভিন্ন রূপ, সম্ভাবনা ও সমস্যা তুলে ধরা। এ প্রসঙ্গে জনগণের প্রত্যাশার বিষয়টিও আলোচনা করা হয়েছে। এর সাথে কাজ করে অনেকেই নন্দিত হয়েছেন। এমনকি পেয়েছেন জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত। এর চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। ছিল না এবং হবেও না। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে হয়। এখনও তাই করতে হবে। প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের সংবাদ পরিবেশনার ব্যবস্থাদি পাল্টাতে থাকবে। নতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে একে এগিয়ে নিতে হবে। তবে পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাদের থেকে যাবে চাহিদা। এ দায়িত্বের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন বা আছেন তারা সর্বোতভাবে আপদহীন ছিলেন এমন নয়। জেল-জুলুমের ভীতি ও নজির রয়েছে। এটা দ্রুত কেটে যাবে এমন আশা করার সঙ্গত ভিত্তি দেখতে পাই না। অন্যদিকে কর্পোরেট জগতের স্বাভাবিক নিয়মে এখানেও থাকবে এমনকি জোরদার হবে পুঁজির প্রভাব। যারা পুঁজি খাটাবেন তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা গুরুত্ব পেতে থাকবে যথেষ্ঠ। তবে পাঠক, দর্শক, শ্রোতার রুচি, ইচ্ছা ও চাহিদা যে কোনো গণমাধ্যমের টিকে থাকা ও বিকাশ ঘটার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিদ্যমান থাকবেই।

আলী ইমাম মজুমদার : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব