সাম্প্রদায়িক শক্তির পতন

তিনি সেই রাজার মতো ছিলেন যার অঙ্গুলি হেলনে জনগণ উঠতো আর বসতো। তিনি যা বলতেন জনগণ তাই শুনতো। এভাবে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে এক সময় তিনি নিজেকে অতিন্দ্রীয় শক্তির অধিকারী হিসাবে ভাবতে শুরু করেন। শুধু ভাবনায় চিত্ত প্রশান্তি পাচ্ছিল না। তাই একদিন তিনি জনসম্মুখে ঘোষণা করে বললেন, তার জন্ম মাতৃগর্ভে হয়নি। তিনি পরমাত্মা অর্থাৎ পরম সত্তা যার কোনো বিনাশ নেই, যার থেকে আরো অনেক সত্তার সৃষ্টি হয়।

একদিন তিনি সমুদ্রের তীরে গেলেন এবং দীর্ঘ ধ্যানে মগ্ন হলেন। অতপর সমুদ্রের পানিকে বললেন, শুকিয়ে যাও। কিন্তু তখন ছিল জোয়ারের সময়। পানি তো শুকালোই না, বরং তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেক দূরে।

আসলে ক্ষমতার মদমত্ততা এভাবেই রক্তমাংসর মানুষকে অতিন্দ্রীয় শক্তির অধিকারী ভাবতে প্ররোচিত করে। মানব ইতিহাস জুড়ে এরকম ঘটনার কোনো অভাব নেই। সদ্য সমাপ্ত ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে উপরোক্ত একটি চিত্রনাট্য  আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর এই চিত্রনাট্যের সেই অলীক শক্তির অধিকারী চরিত্রটি হচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যিনি মর্ত্যের মানুষ হয়েও  নিজেকে অবিনশ্বর সত্তা হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। নিজেকে ভেবেছিলেন পৌরাণিক কাহিনী'র একটি চরিত্র, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি অনেক দূর যেতেও পেরেছিলেন। পশ্চাৎপদ দরিদ্র হিন্দুরা তার মূর্তি বানিয়ে পূজাও শরু করে দিয়েছিল।

মহাত্মা গান্ধী  খালি গায়ে একটি ধুতি পরিধান করে দারিদ্র্যপীড়িত হিন্দু সমাজকে আকৃষ্ট করে জাগিয়ে তুলেছিলেন বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে। আর নরেন্দ্র মোদি হাজার হাজার বছর পিছনে গিয়ে পৌরাণিক কাহিনী'র অবতার সেজে পশ্চাৎপদ হিন্দু সমাজকে লেলিয়ে দিয়েছেন নিজ দেশের মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে। দু'জনের লক্ষ্য ছিল পিছিয়ে পড়া হিন্দু সমাজ। গান্ধীজি কাজে লাগিয়েছেন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী  শক্তির বিরুদ্ধে আর মোদীজি কাজে লাগিয়েছেন নিজ দেশের মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে। 

ভাবতে অবাক লাগে, এই একবিংশ শতাব্দীতে কেবলমাত্র মুসলিম বিদ্বেষকে পুঁজি করে ইতিহাসসমৃদ্ধ ভারতে বিজেপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক  রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটেছে এবং দশ বছর ধরে শাসন করে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ যে মর্ত্যের মানুষের মর্ত্যলোক ছেড়ে উর্ধ্বলোক থেকে অবতার হিসাব আসার ঔদ্ধত্যের যে পরিণাম হওয়ার কথা, তাই হয়েছে মোদির বেলায়। তাই এই লোকসভা নির্বাচনে  তিনি যেন স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পতিত হয়েছেন ধপাস করে।

নির্বাচনের ফলাফলের অংকের হিসাবে এনডিও জোট সরকার গঠন করতে পারলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে জোটটির তথাকথিত অমর্ত্য শক্তির নিদারুণ পরাজয় ঘটেছে। ঠিক ওপরের ঐ রাজার মতো। জোয়ারে ভেসে গেছেন তিনি। তবুও ফলাফলের পর দু আঙুল উঁচিয়ে ভি চিহ্ন দেখিয়ে মোদিজি বলেছেন, গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। তাহলে এ কথা বলা ভুল হবে না যে, ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে মোদির পদত্যাগ করা উচিত, যা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে হরহামেশা ঘটে থাকে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ্য সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ঢাকা