অবহেলিত ও দারিদ্রপীড়িত রংপুর বিভাগের ঘরে বাজেটে শুধুই শূন্য!

ড. মো. মোরশেদ হোসেন

স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জন করতে হলে বাজেটকে হতে হবে স্মার্ট। কিন্তু এ কেমন বাজেট, যেখানে একটি প্রতিষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দের ঘরে শুধুই শূন্য (০)।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ যেখানে ১৩৪৪ কোটি ৮ লাখ টাকা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ ৯১৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ ৩৫০ কোটি টাকা, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ ৪৯৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, এমনকি নবগঠিত বিভাগ ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ ৩০০ কোটি টাকা,  সেখানে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দের ঘরে একটি শূন্য। এটি বঞ্চনার ধারাবাহিকতায় চূড়ান্ত ফলাফল।

উন্নয়ন বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গত ৩ অর্থবছরের বাজেটে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ যেখানে ১৩৪৪ কোটি ৮ লাখ টাকা (২০২৪-২৫), ১৪০৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা (২০২৩-২৪, সংশোধিত) এবং  ১২০৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা (২০২২-২৩) অর্থাৎ মোট ৩৯৫৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অথচ গত ৩ অর্থবছরে বাজেটে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ ০ (২০২৪-২৫), ২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা (২০২৩-২৪, সংশোধিত) এবং ১৭ কোটি ০৭ লাখ টাকা (২০২২-২৩) অর্থাৎ মোট ৩৮ কোটি ০১ লাখ টাকা। বৈষম্য এখানেই শেষ নয়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবার বরাদ্দ পেয়েছে ২২৩৩ কোটি ৫ লাখ টাকা, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ পেয়েছে ১১৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, সেখানে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন তৈরি ২০১৪ সালে শুরু হলেও অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখেনি।

এমনিভাবে ঢাকা ওয়াসা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট পেয়েছে  ২২২০ কোটি ৯ লাখ টাকা, রাজশাহী ওয়াসা পেয়েছে ১২১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সেখানে রংপুর ওয়াসা গঠন নিয়ে আদৌ চিন্তা ভাবনা কেউ করছে বলে জানা নেই, কোনো জন-দাবিও নেই। এ রকম প্রতি খাতে হাজার কোটি টাকার বৈষম্যের শিকার রংপুর বিভাগ।

ভিশন ২০৪১ এ ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল ও খুলনা আটটি আঞ্চলিক নগর কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট যুক্তিযুক্তভাবেই সুপ্রতিষ্ঠিত। সুতরাং, প্রধান গুরুত্ব দেয়া হবে অবশিষ্ট পাঁচটি নগরের নাগরিক সুবিধা সংবলিত অবকাঠামো শক্তিশালী করায়। ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর দারিদ্র বিমোচনের কৌশল হলো “পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুদান বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শক্তিশালী করে তোলা”। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় রংপুর বিভাগে স্থানীয় সরকার ও অবকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ কম।

দেশের খাদ্য চাহিদার ৫০ ভাগ এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রায় ৭০ ভাগ কাঁচামাল উত্তরাঞ্চল থেকে সরবরাহ করা হলেও এ অঞ্চলে অদ্যাবধি কাঁচামাল বা কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেনি। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সকল অঞ্চলে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ ও  রপ্তানি আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে “বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০” অধ্যাদেশ দ্বারা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান ও অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও ২০১০ সালের ৪২ নং আইন “বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০” এর শুরুতে সুস্পষ্ট বলা রয়েছে “দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে উৎসাহ প্রদানের জন্য পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর এলাকাসহ সম্ভাবনাময় সকল এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং উহার উন্নয়ন, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন”।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ সরকারি ৬৮টি ও বেসরকারি ২৯টি অর্থাৎ মোট ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩৬টি (সরকারি ১৮টি ও বেসরকারি ১৮টি), চট্টগ্রাম বিভাগে  ২৫টি (সরকারি ২১টি ও বেসরকারি ০৪টি), রাজশাহী বিভাগে ০৮টি (সরকারি ০৬টি ও বেসরকারি ০১টি), খুলনা বিভাগে ০৮ টি (সরকারি ০৭টি ও বেসরকারি ০১টি), সিলেট বিভাগে ০৬ টি (সরকারি ০৪টি ও বেসরকারি ০২টি), ময়মনসিংহ বিভাগে ০৮টি (সরকারি ০৬টি ও বেসরকারি ০২টি), রংপুর বিভাগে ০৪ টি (সরকারি ০৪ টি)  এবং বরিশাল বিভাগে ০৩ টি (সরকারি ০৩টি) বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ ৩২৫ কোটি টাকা, মহেশখালি অর্থনৈতিক অঞ্চল-৩ এর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ ২৬৪ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের তিনটি প্রকল্পে বরাদ্দ ৭৮১ কোটি ১৬ কোটি টাকা। দেখা যায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দ।  বিশেষ এ অর্থনৈতিক অঞ্চল সমূহে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে ভারত, জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড। বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদিআরব ও অন্যান্য দেশকে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করার। পাশাপাশি রংপুর বিভাগের চিত্র ভিন্ন। রংপুর বিভাগে ৪টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেলেও অগ্রগতি নেই। রংপুর বিভাগে মোট ৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। রংপুর বিভাগের মধ্যে প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আছে দিনাজপুরে। এ জন্য দিনাজপুর সদর উপজেলার সুন্দরবন মৌজায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে  ৮৭ একর খাস জমি হস্তান্তর করেছে দিনাজপুর জেলা প্রশাসন ২০১৯ সালে। মোট তিনশ আট একর জমির উপর এই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা রয়েছে। বাকি ২২১ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তবে এই অধিগ্রহণযোগ্য জমির উপর ঘরবাড়ি, স্থাপনা ও গাছপালা থাকায় তা স্থাবর সম্পত্তি। হুকুমদখল আইন ২০১৭ মোতাবেক ওই ২২১ একর জমি অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হবে।

দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর সম্প্রতি দিনাজপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলকে প্রাথমিক লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। পঞ্চগড় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ২১৭ একর জমি বেজাকে হস্তান্তর করা হয়েছে ২৪ আগস্ট ২০২০ তারিখে। প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট করা হয়েছে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে। তারপর আর অগ্রগতি নেই। নীলফামারী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য ১০৬ একর খাসজমি বেজার নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ৩৫৭ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য স্কেচ ম্যাপ, দাগসূচি ও ধারণকৃত ভিডিও চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ করা হয় কিন্তু প্রকল্প স্থাপনে কোন অগ্রগতি নেই।  নীলফামারী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট করা হয়েছে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে। কুড়িগ্রাম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ১৪৯.৭৭ একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আর অগ্রগতি নেই। রংপুরের জেলা প্রশাসন প্রথমে গঙ্গাচড়ার মহীপুর, এরপরে রংপুরের লাহিড়ীহাটে, পরবর্তীতে শ্যামপুর সুগার মিল এলাকায়, বর্তমানে কাউনিয়ার টেপা মধুপুরে খাস জমি চিহ্নিত করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্বাচন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, কিন্তু অদ্যাবধি তার কোন পদক্ষেপ নেই। রংপুরে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কেবল জমি নির্বাচনে প্রায় ১ যুগ পার হয়েছে।

শিক্ষা বাজেটের বরাদ্দে রংপুর বিভাগের অবস্থান হাস্যকর। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে যেখানে শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা বাজেট বরাদ্দ পেয়েছে ২৬৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৯৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ৩১৪ কেটি টাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৪৬ কোটি ১২ লাখ টাকা, সেখানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ মাত্র ১ লাখ টাকা।

স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ নেই রংপুর বিভাগে, তবে বঞ্চনা আছে। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে বরাদ্দ ১৫০০ কোটি টাকা, চট্টগাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে বরাদ্দ ১০১৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে বরাদ্দ ১৪৩৯ কোটি টাকা। রংপুর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও এ বাজেটে কোন বরাদ্দ পায়নি।

কৃষিখাত রংপুর অঞ্চলের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে এ খাতে রংপুর অঞ্চলের জন্য উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ নেই।

উল্টো অনেক প্রকল্প বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেমন- রংপুর, দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলার উৎপাদিত টমেটো সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও এবারে কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের নতুন জাতের গম ও ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ ও সমপ্রসারণ কর্মসূচিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ১ কোটি ২৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও এবারে কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি।

দারিদ্র্যশূন্য দেশ গড়তে যেমন প্রবৃদ্ধিকে হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দারিদ্র্য নিরসনমূলক। আর অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে  পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। অবকাঠামোগত দিক থেকেও রংপুর বিভাগ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। যার অন্যতম প্রধান কারণ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দে আঞ্চলিক বৈষম্য। যা ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে এডিপি’র বরাদ্দের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারস (বিআইপি) এর ‘জাতীয় বাজেটে আঞ্চলিক উন্নয়ন ভাবনা: বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অঞ্চলভিত্তিক বরাদ্দের তুলনামূলক চিত্র’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটিতে প্রতীয়মান হয়েছে।

২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এডিপিতে রংপুর বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র গড় হিসাবে ৩.১৩ শতাংশ, যেখানে ঢাকা বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৮.৫৪ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই পরিমান কমে দাঁড়িয়েছে ০.৯৮ শতাংশ। ২০২৪-২৫ সালের উন্নয়ন বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বর্তমানেও এ বরাদ্দের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, বৈষম্য শুধু বিভাগগুলোর মধ্যেই নয়, একই সঙ্গে তা একটি বিভাগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত জেলাগুলোর মধ্যেও বিদ্যমান। বাংলাদেশের জেলাগুলোয় বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অতি উচ্চ বৈষম্য রয়েছে। দেশের মধ্যাঞ্চল তুলনামূলকভাবে বরাদ্দের বেশিরভাগ অংশ পেয়ে থাকে। এডিপিতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়া জেলাগুলো হচ্ছে নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও বগুড়া। বাংলাদেশে গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলোর অবস্থান মূল্যায়ন দরকার। বাংলাদেশে যে মেগা প্রকল্প রয়েছে তার অবস্থান উন্নত অঞ্চলগুলোতে। পিছিয়ে পড়া রংপুর অঞ্চলে কোন মেগা প্রকল্প নেই।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বিজ্ঞান, প্রতিবেশ ও পরিবেশসম্মত বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন বাজেটে কোন প্রকার বরাদ্দ দেয়া হয়নি। এটি বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিকভাবে ব্যপক উন্নয়ন সাধিত হবে। এ ছাড়া বন্যা ও নদীভাঙন  রংপুর অঞ্চলের দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম জেলা বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে দারিদ্র্যের হার জেলাওয়ারী সর্বোচ্চ।

ভিশন ২০৪১-এ স্পষ্টত বলা হয়েছে “বাংলাদেশের ১৫টি দরিদ্রতম জেলার অধিকাংশই বন্যা, নদী ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত উচ্চ অরক্ষণশীলতার বৈশিষ্ট্যযুক্ত। কুড়িগ্রামের দৃষ্টান্ত উদ্বেগজনক, দারিদ্র্য সংগঠন এমনকি স্বাধীনতালাভের ৪৫ বছর পরেও খানা আয়-ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) ২০১৬ এর প্রাক্কলন অনুযায়ী এখানে দারিদ্র্যের অভিঘাতের হার ৭০%।”

বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটা উপহার। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পর সেটা থাকবে না। গবেষণা বলছে ২০৩৪-৩৫ সাল পর্যন্ত আমরা এই সুবিধাটা পাব। তারপর সেটি হারাতে থাকব। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকুরির জন্য মোহগ্রস্ততা আছে। কিন্তু এ চাকুরির জন্য যে সংখ্যক তরুণ আবেদন করেন, তাদের ক্ষুদ্র অংশ সফল হন। অথচ তারা বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এতে তাদের শ্রম, সময় ও মেধা সবই অপচয় হচ্ছে, আমাদের সমাজ-অর্থনীতি তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল খাতগুলো যদি বিকশিত হতো, সেখানে যদি তাদের কাজের সুযোগ তৈরি হতো, তাহলে তরুণরা সরকারি কাজের জন্য মোহগ্রস্ত হতো না। গত ১০-১৫ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি যতটা হয়েছে, কর্মসংস্থান ততটা হয়নি। কাজেই বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমান সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রংপুর বিভাগ হতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের হার কম। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০০৫ সাল হতে ২০২২ এর নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে মোট ১০৫০৯২০৮ জনের। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ৪০৫৭৪৯৬ জন (৩৯%), ঢাকা বিভাগের ৩১২৬৪৩২ জন (২৯.৮%), সিলেট বিভাগের ৮৬১৬২৭ জন (৮.২%), রাজশাহী বিভাগের ৭৩৫২১৭ জন (৬.২%), খুলনা বিভাগের ৬৯০৮৬৪ জন (৬.৬%), বরিশাল বিভাগের ৪৪০১৪৫ জন (৪.২%), ময়মনসিংহ বিভাগের ৪১০৫১৩ জন (৩.৯২%) এবং রংপুর বিভাগের ১৮৬৯১৪ জন (১.৮%)। শুধু ২০২২ সালের জানুয়ারি হতে নভেম্বর পর্যন্ত  চট্টগ্রাম  বিভাগ হতে বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৭২০০৯ জনের, সেখানে রংপুর বিভাগ হতে বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ১৯৯৭৮ জনের। আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ এর পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১৬ সালে যেখানে মোট রেমিটেন্সের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের অর্জন ৪১.৭৮%, ঢাকা বিভাগের অর্জন ৩০.৯৮%, সেখানে রংপুর বিভাগের অর্জন মাত্র ০.৮৫%।

রংপুর বিভাগে দারিদ্রের হার বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২২ জুন ২০২৩ সালে প্রকাশিত খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২ এর প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী  রংপুর বিভাগে দারিদ্রের হার ২৪.৮ শতাংশ, যেখানে জাতীয় দারিদ্রের হার ১৮.৭ শতাংশ। ভিশন ২০৪১ এ দারিদ্র নিরসন কৌশলের মূল উপাদানের একটি হলো সামাজিক সুরক্ষা বা  সোস্যাল সেফটি নেট বৃদ্ধি। কর্মসংস্থানভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব। আবার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল হলো  পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেওয়া। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় রংপুর অঞ্চলে দারিদ্র্য বেশি হলেও সামাজিক সুরক্ষার জন্য আলাদা কোন প্রকল্প এবারের উন্নয়ন বাজেটে নেই।

এটা দুঃখজনক যে, দেশ স্বাধীনের ৫১ বছরেও কোনো অর্থমন্ত্রী রংপুরে এসে একদিনের জন্য রংপুরের উন্নয়ন নিয়ে সুধীজনের সাথে মতবিনিময় করেননি। এ অঞ্চলের মানুষের উন্নয়ন বঞ্চনার কথা শোনেননি। রংপুরের উন্নয়নের জন্য এ অঞ্চলের সকল রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে প্রকল্প গঠন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।

দেশে যখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে, তখন রংপুর বিভাগের জনগণ অনেক পেছনে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার; দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়; মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে; বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে; রাজস্ব- জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে; বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ। শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতা অর্জিত হবে। সকলের দোড়গোড়ায় উন্নত প্রযুক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়নসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সকল সেবা থাকবে হাতের নাগালে। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যয়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ ২০তম অর্থনীতির দেশ হবে। আমরা রংপুরবাসী বাজেটে শূন্য  বরাদ্দ পেয়ে আদৌ স্মার্ট হতে পারবো? তাই আমরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া রংপুর বিভাগের উন্নয়নের জন্য “স্মার্ট রংপুর বিভাগ উন্নয়ন বোর্ড” গঠন, উন্নয়ন সমস্যা চিহ্নিতকরণ, অর্থ বরাদ্দ ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।

ড. মো. মোরশেদ হোসেন: প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর