পশ্চিমবঙ্গে বামেদের কি আর কোনও ভবিষ্যৎ আছে?

পশ্চিমবঙ্গে আবার শূন্য পেল বামেরা। ১৯৭৭-২০১১, টানা চৌত্রিশ বছর দাপটের সাথে রাজত্ব করা বামেরা সেই যে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় শূন্য হয়ে গেল, তারপর আর খাতা খুলতে পারেনি। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে একটিও আসন জিততে না পারার মতো চরম ভরাডুবি হয়েছে তাদের। ২০২৩-এর গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে হারানো ভোট পুনরুদ্ধারের একটা সম্ভাবনা তারা দেখিয়েছিল, কিন্তু সেই ফিরে পাওয়া ভোটের অধিকাংশই আবার ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে হাতছাড়া হয়েছে।

 

এবারের নির্বাচনে এক ঝাঁক তরুণ প্রার্থী দাঁড় করিয়ে প্রচারে বেশ নজর টেনেছিল রাজ্যের মুখ্য বাম দল, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ওরফে সিপিআই(এম)। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সাথে বামের জোটে থাকায় অনেকেই মনে করেছিলেন, এবারের নির্বাচনে জাতীয় সংসদের যে ৪২ টি আসন পশ্চিমবঙ্গে আছে তার মধ্যে অন্তত ডজন খানেকে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে রাজ্যের শাসক দল- মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, ভারতের শাসকদল- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও বাম-কংগ্রেস জোটের মধ্যে। কিন্তু ঘটনাচক্রে গোটা ছয়েক আসনের বাইরে এই জোট বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি।

 

রাজ্যে গতবার জেতা দুটি আসনের মধ্যে একটি হারিয়েছে কংগ্রেস। বাম প্রার্থীরা তিরিশটির মধ্যে মাত্র দুটি আসনে তাদের জামানত বাঁচাতে পেরেছেন, অর্থাৎ সর্বমোট ভোটের ছয় ভাগের একভাগের বেশি পেয়েছেন।

 

কিন্তু কেন বামেদের এই হাল? গত পনের বছরের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির দিকে চোখ রাখলে দেখা যায়, তাদের ভোট কমা শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে, যখন সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ-বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজ্য উত্তাল হয়ে উঠেছিল। বামেদের কৃষক ভোটের একাংশ ও শহুরে বামমনস্ক ভোটারদের একাংশ সেই সময় থেকে তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

 

২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ৫০.৭% ভোট পাওয়া বামেদের ভোট ৪৩.৩%-এ নেমে আসে ২০০৯-এ আর ২০১১-তে ক্ষমতা হারানোর বছরে সেটা হয় ৪১.১%। ২০১৪-য় দেশজুড়ে নরেন্দ্র মোদীর উত্থানের বছরে, বাম ভোটের একাংশ বিজেপির দিকে চলে গিয়ে বামেদের ভোট শতাংশ ৩০-এ নেমে আসে। বিজেপি একলাফে ৫-৬% গড় ভোট থেকে ১৭% ভোট পেয়ে যায়। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বামেরা এই হারানো ভোট কিছুটা পুনরুদ্ধার করলেও এই নির্বাচনে তৃণমূল ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসায় বাম সমর্থকরা একেবারেই হতোদ্যম হয়ে পড়েন। এর পরই তারা ক্রমশ বিজেপির দিকে ঝুঁকতে থাকেন।

 

এরপর ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামেদের ছাপিয়ে বিজেপিই তৃণমূলের মুখ্য বিরোধী হিসাবে উঠে আসার ফলে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বামেদের ভোট ব্যাপকভাবে বিজেপির দিকে চলে যায়। কিন্তু আরেকাংশ, যারা বিজেপিকে আটকাতে বেশী উৎসাহী, তাঁরা তৃণমূলের দিকে চলে যান। সেই যে ধ্বস নামলো, আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।

 

প্রশ্ন আসে, বামেরা ভোট হারাল কেন? এ প্রশ্নের অনেক উত্তর, কারণ ভোট হারিয়েছে অনেক ধাপে। প্রথমে জমি আন্দোলনের ধাক্কায় ২০০৮ পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে ২০১৩ পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত কিছু বামমনস্ক ভোট চলে যায় তৃণমূলে। ২০১৪ থেকে, বাকি থাকা বাম সমর্থকদের একাংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। তার একটি কারণ, হিন্দুদের একাংশের মধ্যে বিজেপির এই প্রচার প্রভাব বিস্তার করেছিল যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের তোষণ করছেন, হিন্দুদের বঞ্চিত করছেন। আরেকটি কারণ হল, এই বাম সমর্থকদের একাংশের কাছে তৃণমূলকে হারানোটা এতোটাই বেশী গুরুত্বপুর্ণ ছিল যে,  যে বিজেপিকে বাম দলগুলো বরাবরই সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছে, সেই বিজেপিকেই তারা তৃণমূল বিরোধী শক্তি হিসাবে বেছে নেয়।

 

এর পেছনে নিশ্চয়ই বাম সমর্থকদের ওপর তৃণমূলের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের একটা ভূমিকা আছে। অনেক বাম সমর্থকই বিজেপির আশ্রয় নেন- বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে থাকায় ‘প্রোটেকশন’ দিতে পারবে মনে করে। এই ভাবে বাম ভোটে যখন বিজেপির বিপুল উত্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০১৯-এ, তখন বাম ভোটারদের আরেকাংশ– সংখ্যালঘু মুসলিম ও ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা– যাদের কাছে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে আটকানোই মুখ্য, তারা তৃণমূলের দিকে হেলে পড়েন। তখন থেকে এই ২০২৪-এর নির্বাচন পর্যন্ত সেই একই ধারা বজায় আছে।

 

তৃণমূল-বিজেপি মেরুকরণের চাপে বামেরা কেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, সে নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া চলছে ও চলবে। গোটা দেশেই বিজেপির রাজনীতি এক প্রবল মেরুকরণের হাওয়া তৈরি করেছে। বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বিরোধী জনতা বেছে নিচ্ছেন বিজেপির বিরুদ্ধে যে দল বা জোট সবচেয়ে শক্তিশালী তাকে। এক্ষেত্রে দুর্নীতি, শাসনের অব্যাবস্থার মতো বিষয়গুলো পেছনে চলে যাচ্ছে।

 

এমনিতেই বিশ্বজুড়ে বাম আন্দোলনে ভাঁটা ও দক্ষিণপন্থীদের উত্থানের একটা পর্যায় চলছে। কমিউনিস্ট বিপ্লবের আবেদন কমেছে। তৃণমূল সরকারের নানান জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও– তৃণমূলের এক বড় জনভিত্তি তৈরি করেছে সমাজের প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে, বিশেষত কৃষকসমাজ ও মহিলাদের মধ্যে। এর থেকে ভালো কী বামেরা দিতে পারে, তা তারা এখনও মানুষকে বোঝাতে পারেননি। তৃণমূল বারবারই বলে, নীতিতে তারা বাংলার বামেদের থেকে বেশী বাম, বেশী জনকল্যাণকামী। বামেরা তৃণমূলের এই দাবি নস্যাৎ করতে পারেননি।

 

১৯৯৮-২০০৬-এর বেশিটা সময়ই তৃণমূলের সাথে বিজেপির জোট ছিল, তবু ২০১৪-পরবর্তী সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি বিরোধী আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, যে-কারণে শুধু মুসলিমরা নয়, ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরাও বিজেপিকে রুখতে তার ওপরেই বাজি ধরছেন।

 

ঘটনা হলো, সেই ২০০৭-০৮ সাল থেকেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার দলীয় কর্মসূচিতে নানান বাম প্রভাব টেনে আনতে থাকেন। তার সরকার এখনও পর্যন্ত সেই অর্থে কোন বড় জনবিরোধী নীতি গ্রহণ করেনি। তিনি শিল্পোন্নয়ন করতে চাওয়া বামেদের সরকার ফেলে দেওয়ার পর থেকে রাজ্যে কোনও বড় শিল্প আনতে পারেননি, এই হুতাশ বামেরা প্রায়ই করে থাকেন, কিন্তু যারা বড় শিল্প চান, তাদের কাছে বামেদের থেকে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বেশি।

 

তৃণমূলের ১৩ বছরের রাজ্য শাসন ও বিজেপির ১০ বছরের দেশ শাসনে নিশ্চয়ই একাংশের ভোটার তৈরি হয়েছেন যারা দুপক্ষের ওপরই অসন্তুষ্ট। এই ভোটারদের ভোট, মেরুকরণ এড়িয়ে, কীভাবে নিজের বাক্সে নিয়ে আসতে পারেন বামেরা– বা আদৌ পারেন কিনা– সেটা দেখার বিষয়। 

 

বাম থেকে তৃণমূলে ভোট যাওয়ার তবু একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বাম সরকারকে ফেলতে খানিক বাম পথই ধরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে পেয়েছিলেন অনেক বাম মনস্ক বুদ্ধিজীবী ও ছোট বাম দলকে। কিন্তু বাম সমর্থকরা যখন তাদের আদর্শগত শত্রু দক্ষিণপন্থীদের দিকে ঝুঁকে পড়েন, তখন বুঝতে হয় যে বামেরা মতাদর্শ তাদের সমর্থকদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারেনি। আসলে, দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের শাসন বাম দলগুলোর আদর্শগত জোর অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল। তদুপরি, নয়াউদারনীতিবাদের উত্থানের সাথে উদ্ভুত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে তারা হিমশিম খেয়েছেন।

 

বর্তমান বাংলায়, তৃণমূলের বিরোধিতা না করলে তারা রাজ্যসরকার বিরোধী ভোট পাবেন না, আর বিজেপির তীব্র বিরোধিতা করে বিজেপি সম্পর্কে সমর্থকদের মোহভঙ্গ করতে না পারলে বিজেপি থেকে তাদের ভোট ফেরাতে পারবেন না। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই প্রতিবেদককে বলেন, রাজ্যে বাম ও কংগ্রেস যৌথভাবে তৃণমূল ও বিজেপি দুইয়েরই বিরোধিতা চালিয়ে যাওয়ার যে পথ ধরেছে, সেই পথেই এগোতে হবে। কিন্তু ঘটনা হলো, জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় কংগ্রেস চায় বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে পাশে পেতে। তাই রাজ্য কংগ্রেসকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কতটা আগ্রাসী হওয়ার ছাড়পত্র দেবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, তা অনিশ্চিত। ফলে, বামেদের হয়ত শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস-নির্ভরতাও কমাতে হতে পারে। সেটা নিশ্চয়ই তাদের লড়াই আরও কঠিন করে দেবে।

 

এই সব প্রতিকূলতার সম্ভাবনার মাঝেও বামেদের কাছে একটাই আশার আলো থাকতে পারে– জাতীয় স্তরের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি আরেকটু দুর্বল হয়েছে। এই সুযোগ তারা কতটা, কীভাবে কাজে লাগাতে পারেন, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে আগামী দিনের বঙ্গ রাজনীতির গতিপথ।