ভূ-রাজনৈতিক জটিলতায় বাংলাদেশ 

ছবি. ইন্টারনেট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর বিগত ৮৭ বছরে নানা মেরুকরণের ফলে বিশ্ব এক জটিল ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছে, যা ছোট ছোট দুর্বল দেশগুলোকে বৃহৎ শক্তিবর্গের দাবার গুটিতে পরিণত করেছে। বিশেষ করে, বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা যে বৈশ্বিক দুর্গতি সৃষ্টি করেছে এবং নতুন যে বিশ্বব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশগুলোর ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতা সীমিত করে ফেলেছে। বিশেষ করে, সেইন্ট মার্টিনকে কেন্দ্র করে বার্মার আগ্রাসী সামরিক তৎপরতা বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটলে একক পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় যুক্তরাষ্ট্র। শুরু হয় একমুখি বিশ্বব্যবস্থা। এর ফলে পৃথিবীতে দেখা দেয় চরম ভারসাম্যহীনতা। প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো পূর্ব-ইউরোপে সম্প্রসারিত হয় যা একদা সোভিয়েত ব্লকভুক্ত ছিল। একই সঙ্গে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়ায় আক্রমণের ঘটনা ঘটে। লক্ষণীয় ঘটনা হচ্ছে, ঠান্ডা যুদ্ধোত্তর বিগত ৩৩ বছর এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় আমরা কেবল যুদ্ধ-বিগ্রহই দেখেছি। সর্বশেষ ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব বিপর্যয়কারী একটি যুদ্ধ দেখছি। একই সঙ্গে তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিশ্বকে আরো বিভক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। 

একই সময়ে অর্থাৎ ঠান্ডা যুদ্ধ-উত্তর গত ৩৩ বছরে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পরাশক্তি হিসাবে চীনের আবির্ভূত হওয়া, ধ্বংস স্তুপের ওপর রাশিয়ার পুনরুত্থান, মার্কিন ডলারের বিপরীতে নতুন মুদ্রা ব্যবস্থার সূচনা এমন এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার আভাস দিচ্ছে যা কার্যত আমেরিকার রুল বেইজড ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, একদিকে আমেরিকা ও তার মিত্ররা; অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন এবং তাদের মিত্ররা। অনেকটা ঠান্ডা যুদ্ধ পূর্বেকার সময়ের মতো। কিম্বা অন্যভাবে বলা যায় পশ্চিমা বিশ্ব বনাম অপশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব। এর ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলো কোনদিকে থাকবে, তা নিয়ে একটা কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। 

অন্যদিকে  মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তনশীল ঘটনা প্রবাহ সুদূরপ্রসারী এক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। বিশেষ করে সিরিয়ায় রাশিয়ার  অবস্থান, সামরিক দিক দিয়ে ইরানের প্রভাব বিস্তার, আমেরিকার প্রভাব থেকে সৌদী আরবের বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহ এক নবতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এর ফলে বহু বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে আমরিকার একচ্ছত্র আধিপত্যের দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যে এক সময় আমেরিকার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। এছাড়া আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ও তালেবানদের আবার ক্ষমতাসীন হওয়ায়  'মধ্যএশিয়ার' দৃশ্যপটও বদলে গেছে। এতে একদিকে ইরান তার সীমান্তে মার্কিন উপস্থিতির ফলে সৃষ্ট আতংক থেকে রক্ষা পেয়েছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে বসে পাকিস্তানকে ত্রাসের মধ্যে রাখার পাশাপাশি 'মধ্যএশিয়ায়' বাণিজ্যের পথ সুগম করার ভারতের আকাঙ্ক্ষাও ভেস্তে গেছে। পক্ষান্তরে রাশিয়ার বহুদিনের স্বপ্ন, গরম পানিতে অর্থাৎ আরব সাগরে আসার পথ খুলে গেছে। অর্থাৎ পুরানো দিনের অনেক সমীকরণ বদলে গিয়ে নতুন নতুন সমীকরণ দাঁড়িয়েছে। যেমন বহু বছর ধরে আমেরিকা ও ইউরোপ মনে করে আসছে যে, তাদের সমস্যা মানে সারা বিশ্বের সমস্যা। কিন্তু সে দৃশ্যপট এখন বদলে গেছে। ঠিক এরকম একটি ভূ-রাজনৈতিক পটভূমিতে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশসমূহের ভবিষ্যত কোন পথে অগ্রসর হবে তা নিয়ে  হিসাবনিকাশ করার সময় এসেছে।

মূলত এ ধরনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কী ধরনের ভূমিকা পালন করবে সেটা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে এক পিচ্ছিল পথ।

এখন আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। প্রথমেই বলতে হয় যে, স্বাধীনতা লাভের সূচনাতেই বাংলাদেশের  উচিত ছিল একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করা, যা পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির আঙ্গিকে টেকসই হতে পারে। যদিও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব- কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়- এই হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি। তিনি এই প্রসঙ্গে সুইজারল্যান্ডের  কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে তিনি আর সে অবস্থানে থাকতে পারেননি। কারণ ১৯৭৩ সালে তিনি ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে পূর্বতন অবস্থানের আমূল পরিবর্তন ঘটান। তখন বিরোধিরা ঐ চুক্তিকে 'গোলামী চুক্তি' হিসাবে অভিহিত করেছিল। ঐ চুক্তিই মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্র নীতির মূল চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। যে করণে ১৯৯৮ সালে ঐ চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেই মৈত্রী চুক্তিই অনুসরণ করে পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনা করে থাকে। যা বাংলাদেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য যে সরকারই ঐ নীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের চেষ্টা করেছে তারই পরিনতি হয়েছে ভয়াবহ। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তারই মর্মান্তিক  শিকার। বর্তমান বিএনপির দুর্দশা একই কারণেই। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের  সর্বাত্মক শাসন ভারতেরই সহযোগিতার ফলশ্রুতি। কারণ ভারতের কাছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কোনো মূল্য নেই। ভারতের কাছে যে কোনো অবস্থায় বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব অটুট রাখাই মুখ্য। যেমনটা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু বলেছিলেন, ভারতের আশেপাশের ছোট ছোট দেশগুলোর সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা থাকতে পারে; কিন্তু  রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকতে পারে না। আর এ ক্ষেত্রে ভারতের একমাত্র বিশ্বস্ত দল আওয়ামী লীগ। 

এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯৭১ সলে ভারত রশিয়ার সঙ্গে যে মৈত্রী চুক্তি করেছিল সেটার অনুকরণে, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিসন্ধিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। ভারত রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি করেছিল নিজের নিরাপত্তা স্বার্থকে সামনে রেখে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে যে মৈত্রী চুক্তি করেছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের ওপর নিরঙ্কুশ প্রভাব বিস্তার করা। মূলত, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানই বাংলাদেশকে এই নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। দেশটি তিন দিক দিয়ে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। পূর্ব দিকে কিছু অংশ  বৈরী বার্মার সীমানার সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশি। শুধু তাই নয়, বিশ্বে বাংলাদেশ একমাত্র মুসলিম প্রধান দেশ যার অন্য কোনো মুসলিম দেশের সঙ্গে সংযোগ নেই। অথচ অন্য সকল মুসলিম দেশের সঙ্গে অন্য একটি মুসলিম দেশের সংযোগ রয়েছে। অর্থাৎ দুটি অমুসলিম দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গোড়া থেকেই সংশয়, সন্দেহের আবর্তনে আবর্তিত। এ রকম একটি ভৌগোলিক অবস্থানের করণে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ টেকসই বৈদেশিক নীতি অব্যাহত রাখতে পারেনি। বারবার হোঁচট খেয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলেই পুরোপুরি ভারতমুখি হয়ে গেছে। এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে ঠান্ডা যুদ্ধোত্তর এক মেরুকেন্দ্রিক মার্কিন প্রভাবের সময়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কনটেইন করার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে যে মিত্রতার বন্ধন রচনা করে তার অবধারিত ফল হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশের জবরদস্তিমূলক আওয়ামী শাসন। ঐ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বাংলাদেশের জাইগিরদার করে দেয়। ভারত এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে তার বিশ্বস্ত মিত্র আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে।  

অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে কিম্বা ক্ষমতার বাইরে থেকেও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষ করে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তাইওয়ান ইস্যুকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে সৃষ্ট আস্থাহীনতা কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র রুষ্ট হতে পারে এই ভয়ে দলের কিছু লোক এটা হতে দেয়নি। অথচ চীনের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ঐতিহ্যগত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সে সম্পর্ক  মজবুত করেছিলেন। বিএনপির উচিত ছিল সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীনকে অনুমতি দেওয়া। সেটা না দেওয়ায় চীন তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চীনের লক্ষ্য হচ্ছে, অর্থ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে জায়গা করে নেওয়া। কারণ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে তার প্রয়োজন। কিন্তু ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশ চীনের কৌশলগত পার্টনার হোক।

আবারো সেই ভূ-রাজনৈতিক নিষ্ঠুর খেলার প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে। সুতরাং বিএনপিকে এমন একটি কৌশলগত বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করতে হবে যাতে বৃহৎ শক্তিরবর্গের দ্বন্দ্বে পিষ্ট না হয়। 

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে যে 'লুক ইস্ট' পলিসি হাতে নিয়েছিল সেটার ওপর প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আর সেটা করতে গেলে অবশ্যই বার্মা ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। করণ চীন আমাদের নিকটতম সুপার পাওয়ার। শিলিগুড়ি উপত্যকা দিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দুরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। যদিও ভারতের প্রতিবেশী অন্য পাঁচটি দেশ- নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের ভৌগোলিক কিছু সুবিধা আছে। যেমন পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত রয়েছে। অন্যদিকে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ সমুদ্রের মধ্যে বিচ্ছিন্ন দুটি দেশ। এ দিক দিয়ে বাংলাদেশ অবশ্যই বেকায়দা অবস্থানে আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ভারতের আগ্রাসী নীতি বাংলাদেশের জন্য নাজুক অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আর এই জটিলতা মাথায় রেখে নির্ধারণ করতে হবে পররাষ্ট্রনীতি। এটা মনে রাখতে হবে যে, ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা এবং পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়ার কারণে পাকিস্তান যা এফোর্ড করতে পারে বাংলাদেশের পক্ষে তা সম্ভব নয়। 

এই পটভূমিতে আমাদের প্রতিরক্ষা পলিসি কী হওয়া উচিত সেটাও নির্ধারণ করা দরকার। আর ধরনের নীতি না থাকার কারণে বার্মার চলতি সামরিক তৎপরতার বিরুদ্ধে  বাংলাদেশের অবস্থান অস্পষ্টই মনে হচ্ছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক