শেখ হাসিনা কি এবার ভারতকে ম্যানেজ করতে পারবেন?

ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ভারত যাচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুননির্বাচিত হওয়ার পর এটি তার দ্বিতীয় ভারত সফর। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি দেশের সরকার প্রধান সাধারণত অন্য দেশ সফর করেন না। শুধু এ কারণে নয়— হাসিনার দিল্লিযাত্রা আরো কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের পর হাসিনা যাবেন চীনে। চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প ঝুলে আছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এদিকে ভারত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করতে উপর্যপুরি ব্যর্থ হয়েছে, যা বাংলাদেশকে তিস্তা নিয়ে চীনের দ্বারস্থ হতে একভাবে বাধ্য করেছে ।

কিন্তু বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এতো সহজও নয়। গত মাসে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দু জানিয়েছে, বাংলাদেশে তিস্তার জন্য চীনের প্রকল্প ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। সর্বোপরি, এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ভারতীয় রাজ্যগুলির বেশ কাছে অবস্থিত।

মজার বিষয় হচ্ছে, যে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারত এতোদিন গড়িমসি করছে, সেই ভারতই বাংলাদেশেকে প্রস্তাব দিচ্ছে যে তারা তিস্তা প্রকল্পে কাজ করতে আগ্রহী। ব্যপারটা অনেকের কাছে প্রহসন মনে হলেও এটা কিছুটা সাপ হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ার মতো একটা বিষয়।

চীনের সাথে প্রস্তাবিত এ তিস্তা প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রায় আট বছরের পুরানো। শুরুতে এটা ছিল যমুনা নদী ঘিরে। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুরোধে চীন তিস্তা নদীকে এ প্রকল্পে যুক্ত করে। কিছুদিন আগে পাওয়ার-চায়না ইউটিউবে একটি ভিডিও-ও ছাড়ে এটা নিয়ে।

প্রকৃতপক্ষে চীনের প্রস্তাবিত এ প্রকল্প থেকে আমাদের লাভবানই হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে ১৭১ বর্গ কিলোমিটার জমি পুনরুদ্ধার করা হবে। হবে নগরায়ন, সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প, কৃষি উন্নয়ন এবং বাড়বে জনবসতির জায়গাও।

কিন্তু এই প্রকল্পে পথের কাঁটা হিসাবে দাড়িঁয়ে আছে ভারত। চীন দোকলামে ভারতের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে। তিস্তা প্রকল্প দেশটির সীমান্তের খুবই কাছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ যদি চীনের সাহায্য নিয়ে এরকম কিছু করতে পারে তবে তা চীনকে বাংলাদেশে জনপ্রিয়ও করবে অনেক বেশি। যেখানে ভারত বিরেধীতা বাংলাদেশে হালে পানি পাচ্ছে প্রচুর।

ভারত তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য আওয়ামী লীগের মতো একটি অজনপ্রিয় সরকারকে বছরের পর বছর চোখ বন্ধ করে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর এই সরকারই এখন চীনের ঋণের মুখাপেক্ষী। চীনের ঋণ পাওয়ার জন্য ভারতপন্হী আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাকুল। খোদ প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন তার সরকার তিস্তা প্রকল্পের জন্য চীনের দিকে তাকিয়ে আছে।

তার এই তাকানো ভারত যে ভালোভাবে দেখছে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাসিনার এবারের দিল্লিযাত্রা সহজ হবে না। এ যেন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। একদিকে বাংলাদেশ সরকারকে চিন্তা করতে হবে ভারতের ভূরাজনৈতিক মাথাব্যথার বিষয়টি। সাথে আছে নিজ অর্থনৈতিক দুরবস্থা, যা মোকাবেলায় চীনকে বাংলাদেশের দরকার।

তিস্তা প্রকল্পের আলাপ-সালাপ চলাকালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিন নিজেই বাংলাদেশ সফরে আসেন। দেশটির কাছে তিস্তার গুরুত্ব এটা থেকে বোঝা যায়। বাংলাদেশেকে ভবিষ্যত ঋণ দেওয়ার সাথে তিস্তা শর্ত হিসাবে আসলে তা অবাক করার মতো কিছু হবে না।

শুধু ঋণ নয়, চীন এখন বাংলাদেশের কাছে নির্ভরশীল আরো অনেক কারণে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বার্মায় আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের একটা বিশাল অংশ দখল করে বসে আছে। কথিত আছে যে, এদের অস্ত্রের একটা অংশের যোগানদাতা চীন নিজে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান বা উত্তর-পূর্ব সীমান্তে চীনের উপস্থিতি দেশটিকে আমাদের কাছে ভূরাজনৈতিক কারণে নির্ভরশীল করে তুলেছে অনেক বেশি। একভাবে চিন্তা করলে শুধু ভারত আর বার্মা না, বাংলাদেশের সীমান্ত এখন চীনের সাথেও আছে।

হাসিনা একা চীনের দিকে তাকিয়ে নেই। নিকট প্রতিবেশী ভারতের দাদাগীরি ও এ বিষয়ে মার্কিন নীরবতা বাংলাদেশের অনেককে চীনকে এটি নির্ভরশীল বিকল্প বন্ধু হিসাবে ভাবতে বাধ্য করছে। আর যাই হোক, চীন ভারতের মতো বাংলাদেশে কথিত গুম-খুনের সাথে জড়িত না। এ সরকারের প্রতি চীনের রাজনৈতিক সমর্থন কখনই ভারতের মতো খোলামেলা ছিলো না।

এই অবস্থায় হাসিনার চীনের দিকে তিস্তাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ঝুঁকে পড়া ভারতের জন্য যে মনোপীড়ার কারণ হবে তা বলাই বাহুল্য। গণতন্ত্র-নির্বাচন ইত্যাদি ইস্যুতে আওয়ামী লীগ গর্তে পড়লে আমরা দলটির হোমড়া-চোমড়াদের বলতে শুনি যে ভারত সব ম্যানেজ করে দেবে। কথাটা ভুলও না। এখন পর্যন্ত ভারত আওয়ামী লীগের হয়ে তরফদারি করেই চলেছে। কিন্তু এবার হাসিনার ম্যানেজ করতে হবে ভারতকে।

এ কাজ তার সরকার করতে পারবে কিনা তা আমরা কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারবো। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, দুই আঞ্চলিক পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলার যে নীতি সরকার এতোদিন সাফল্যের সাথে করে এসেছে তার দিন প্রায় শেষ।

 ম হ্লিং : বার্মিজ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী