উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ ও গণমাধ্যম

লেখাটি গণমাধ্যম নিয়ে তিন কিস্তিতে লেখা একটি নিবন্ধের প্রথমাংশ। বাকি দুই অংশ হচ্ছে ‘ফিলিস্তিন ও গণমাধ্যম’ এবং শেষাংশ ‘ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশের গণমাধ্যম’

গণমাধ্যম সম্পর্কে আমাদের বিস্তর রঙিন বা রোমান্টিক ধারণা রয়েছে। যে কারণে আমরা দাবি করে থাকি শক্তিশালী গণমাধ্যম গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। অর্থাৎ গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী গণমাধ্যম দরকার। এই দাবি অস্পষ্ট। আসলে ইতিহাসে এভাবে দাবি করার পক্ষে বিশেষ প্রমাণ নাই। কথাটা আসলে উল্টা করে বলা। পাশ্চাত্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে উদার ব্যক্তিতান্ত্রিক চিন্তার বিকাশ ঘটেছিল। বিপ্লবের আগে শিল্প, সাহিত্য, সংবাদপত্রসহ সকল মাধ্যমেই প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সামন্তীয় বা পেটিবুর্জোয়া চিন্তাধারার বিপরীতে ব্যক্তির মহিমা প্রচারিত হয়েছে। অর্থাৎ গণমাধ্যমের বিকাশ সমাজের সামগ্রিক বিকাশ থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘটেনি। গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার বিকাশ, শ্রেণি হিশাবে বুর্জোয়া শ্রেণির গঠন, গণমাধ্যমের রূপান্তর এবং নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন সবই সমান্তরাল ঘটনা। বিচ্ছিন্নভাবে একটিকে আরেকটির কারণ হিশাবে যেমন প্রমাণ করা কঠিন, তেমনি বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত হওয়ার মধ্য দিয়ে উদার, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিশাবে গণমাধ্যমেরও ক্ষয় ঘটেছে। গণমাধ্যম আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রে সমাজের শক্তিশালী বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেছে। পাশ্চাত্যের শিল্পসাহিত্য সংবাদপত্রসহ সকল গণমাধ্যমের স্বভাব এভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন ঘটেছে বুর্জোয়া শ্রেণির আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে। তেমনি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের বর্তমান কালপর্বে গণমাধ্যম ক্রমশ কোনো দেশ বা রাষ্ট্র নয়, গ্লোবাল কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। এ স্বার্থ কোনো দেশের বা রাষ্ট্রের স্বার্থ ভাবলে আমরা ভুল করব।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের অভিযানের পর শক্তিশালী কর্পোরেট গণমাধ্যম তাদের নিজ নিজ দেশে কিম্বা জনগণের স্বার্থ নয়, নগ্নভাবে ভিন্ন রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করেছে। গণমাধ্যমের মধ্যে আমরা যে দ্বন্দ্ব বা লড়াই দেখি, সেটা এক সময় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণ্রির লড়াই সংগ্রাম দিয়ে বোঝা যেত। সেটা আলাদা কিছু ছিল না। আধুনিক রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর সেই রাষ্ট্র সচল রাখবার প্রাতিষ্ঠানিক শর্তের মধ্যে বুর্জোয়া শ্রেণিকে তাদের পক্ষের গণমাধ্যমকে শক্তিশালী রাখতে হয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নকে সচল এবং বর্তমান এককেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে পাশ্চাত্য গণমাধ্যমকে অবশ্যই কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। তাই প্রধান প্রধান কর্পোরেট মিডিয়ায় আমরা জায়নবাদি সেটলার কলোনিয়াল রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষেই প্রচার দেখি। গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী গণমাধ্যম দরকার-এই বাচাল ও বাসি কথা মাথায় রাখলে গণমাধ্যম নিয়ে স্বাধীনভাবে ভাবা ও পর্যালোচনা সম্ভব না।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা বাস্তবে দেখেছি এবং দেখছি কীভাবে গণমাধ্যম একটি গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র কাঠামো টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। বৃহৎ ঐতিহাসিক পেক্ষাপটে গণমাধ্যমের ভূমিকা বুঝতে হলে ঔপনিবেশিক কালপর্বে উপনিবেশ স্থাপন এবং তার পক্ষে যুক্তি ও ন্যায্যতা হাজির করা, সাম্রাজ্যবাদের যুগে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে মতাদর্শ ও ন্যায্যতা তৈরি এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে পুঁজি বা কর্পোরেট স্বার্থে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম খুব নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। তাই গণমাধ্যমের প্রতি কোন আলাগা পিরিতি বা রোমান্টিসিজমের সুযোগ নাই বললেই চলে।

কিন্তু বিদ্যমান ক্ষমতা বা শক্তির বিপরীতে ‘গণ’ বা জনগণের পক্ষে কি গণমাধ্যমের কোনো ভূমিকা নাই? অবশ্যই আছে। সেই ক্ষেত্রে তাকে ‘গণমাধ্যম’ না বলে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। তাকে আমরা প্রতিরোধের বয়ান বা ‘গণসাহিত্য’ বলতে পারি – যা সবসময়ই বিদ্যমান ক্ষমতা ও কর্পোরেট পরিসরের বাইরে তৈরি ও উৎপাদিত হয়। তার প্রচারের ধরণও আলাদা। ‘গণমাধ্যম’ বলতে আমরা যেভাবে মূল ধারার কর্পোরেট মিডিয়া বুঝি, তার সঙ্গে এই সাহিত্যের চরিত্রগত ফারাক আছে। উভয়কে এক গণ্য করবার বিভ্রান্তিকর অনুমান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

পুরানা তর্ক

গণমাধ্যম নিয়ে তর্ক পুরানা। নোয়াম চমস্কি এবং এডওয়ার্ড এস. হারম্যানের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ দ্য মাস মিডিয়া’ (১৯৮৮) বহুল পরিচিত গ্রন্থ (Herman and Chomsky 2008) । গণমাধ্যম নিয়ে তর্ককে খুবই নির্ধারক জায়গায় নেয়ার ক্ষেত্রে এই বইটির ভূমিকা রয়েছে। ক্লাসিক বই। গ্রন্থটি তথাকথিত গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যম কিভাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে বয়ান এবং বিদ্যমান ক্ষমতার পক্ষে ‘সম্মতি’ উৎপাদন করে তার পর্যালোচনা। গণমাধ্যম আসলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে জনগণের সম্মতি উৎপাদনের পক্ষে একটি প্রচার ব্যবস্থা। এর স্বরূপ উন্মোচনের জন্য গ্রন্থটি যে বিশেষ বিশ্লেষণের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, সেটা লেখকদের ভাষায় ‘প্রপাগান্ডা মডেল’। সাধারণ জনগণের কাছে বার্তা ছড়িয়ে দিতে গিয়ে খবর বাছাই, বিন্যাস ও উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম বিদ্যমান ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে। প্রভাবশালী, অভিজাত গোষ্ঠির বিভিন্ন নীতি এবং স্বার্থের জন্য কার্যকরভাবে গণসম্মতি তৈরি করা মূল ধারার গণমাধ্যমের কাজ। এ কাজ করতে গিয়ে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তাকে হেরমান ও চমস্কি গণমাধ্যমের প্রচারণার মডেল বা নকশা বলেছেন।

গণমাধ্যম সাধারণত ধনী ব্যক্তি বা বৃহৎ কর্পোরেশনের মালিকানাধীন। এ মালিকানা কাঠামো মালিকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবাদই আদতে প্রকাশ ও প্রচার করে। এরপর রয়েছে বিজ্ঞাপনের ভুমিকা। গণমাধ্যমগুলো বিজ্ঞাপনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞাপনদাতারা বিতর্ক চায় না, অ-বিতর্কিত বিষয়বস্তু পছন্দ করে। যার ফলে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে একটা স্বেচ্ছা সেন্সরশিপ চলে। ফলে ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরগুলো প্রান্তিক ও আড়াল হয়, কিম্বা চাপা পড়ে। তা ছাড়া গণমাধ্যম তথ্যের জন্য সরকার, ব্যবসা এবং বিশেষজ্ঞ উৎসের ওপর নির্ভর করে। তাই প্রায়ই শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি সংবাদ কভারেজে প্রাধান্য পায়। এই উৎসগুলোই সংবাদের একটি স্থির প্রবাহ সরবরাহ করে, গণমাধ্যমের রিপোর্ট এতে সহজ এবং সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু তা সমাজের অধিপতি শ্রেণির স্বার্থকে প্রবল করে তোলে।

গণমাধ্যম মামলা, অভিযোগ, বা সমালোচনা এড়িয়ে চলতে চায়। তাই শক্তিশালী স্বার্থকে বিপর্যস্ত করবার ভূমিকা গণমাধ্যম এড়িয়ে চলে। গণমাধ্যমের যে ‘মডেল’ বা প্রচার ব্যবস্থার কাঠামো ম্যানুফেকচারিং কনসেন্ট বইতে বর্ণনা করা হয়েছে, সেটা সংবাদ উৎপাদন ব্যবস্থার ওপরই বিশেষ ভাবে জোর দিয়েছে। অনেকে একে জনসাধারণের ওপর মিডয়ার প্রভাব হিশাবে ভুল করেন। এ বই সংবাদ উৎপাদনের এ ব্যবস্থা জনগণের ওপর কী ধরণের প্রভাব ফেলে তার পর্যালোচনা করেনি। সেটা ভিন্ন বিষয়। তাই তারা পরিষ্কার বলছেন, “গণমাধ্যম কীভাবে সংবাদ বানায় আর জনগণের ওপর তার প্রভাব কী হয় দুটো আলাদা বিষয়... । এটা অবশ্যই ঠিক যে সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে গণমাধ্যমের ভাষ্যের যোগ থাকে এবং জনগণের অভিমত প্রভাবান্বিত করবার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা থাকে, কিন্তু সেটা মাত্রার বিচার। যেখানে জনগণের স্বার্থের সঙ্গে ক্ষমতাসীন অভিজাতদের তীব্র বিরোধ থাকে, সেখান সরকারি ভাষ্য জনগণের মধ্যে ব্যাপক সন্দেহ তৈরি করে।

যা-ই হোক, আমরা যে কথাটা বইতে বিশেষ ভাবে জোর দিতে চাইছি সেটা হোল, যে সকল শক্তি গণমাধ্যমের চরিত্র নির্ণয় করে প্রপাগান্ডা মডেল দিয়ে তাকেই ব্যাখ্যা-বর্ণনা করা হয়েছে। তার মানে এই নয় এই মডেল থেকে যে কোন প্রপাগান্ডা উৎপাদত হলেই তা সবসময়ই কামিয়াব হবে’ (Herman and Chomsky 2008, 13) ।

গণমাধ্যম ও উপনিবেশ

গণমাধ্যমের এই ভূমিকা শুধু আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ কিম্বা স্বাধীন জাতীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না। হেরমান ও চমস্কির প্রপাগান্ডা মডেল ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদকে ন্যায্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে মিডিয়ার বিভিন্ন ভূমিকা বুঝতেও আমাদের সহায়ক হয়। গণমাধ্যম ঐতিহাসিকভাবে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদি দখলদারিকে স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিশাবে হাজির করতে চেয়েছে। এই উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক বয়ান যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি গণমাধ্যম সাম্রাজ্যবাদী বয়ানও

উৎপাদন করেছে।উনিশ শতকে ভিক্টোরিয়ান প্রেসের যুগে ব্রিটেনের ‘দ্য টাইমস’-এর মতো সংবাদপত্রগুলির নিবন্ধে উপনিবেশের জনগণকে ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ হিশাবে চিহ্নিত করে এমন সব বর্ণনা হাজির করেছিল। সেই সকল বর্ণনার অনিবার্য যৌক্তিক সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় যে, সভ্য হতে হলে কলোনির অধিবাসীদের জন্য অবশ্যই পশ্চিমা সভ্যতা ও ইংরেজের শাসন দরকার। সেই যুক্তি জোরেশোরে পেশও করা হোত। ঔপনিবেশিক আমলে গণমাধ্যম বিভিন্ন যুক্তি ও বর্ণনার মধ্য দিয়ে উপনিবেশবাদকে ন্যায্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই ন্যায্যতাগুলি সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বই ইত্যাদি নানান ফর্মের মাধ্যমে প্রচার করা হোত। প্রায়ই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, বর্বরদের সভ্য করবার মিশন, উপনিবেশের অর্থনৈতিক সুবিধা এবং কলোনির কৌশলগত প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হোত। ‘অসভ্যদের সভ্য’ করবার মিশন ছিল ঔপনিবেশিকতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রধান একটি যুক্তি।

বলাবাহুল্য উপনিবেশকারীরা নিজেদেরই ‘সভ্য’ ও ‘অগ্রসর’ গণ্য করত। সেই অগ্রসরতা বা সভ্যতা প্রমাণের জন্য কলোনির জনগণকে অসভ্য ও বর্বর প্রমাণ করাটাই ছিল যৌক্তিক ও স্বাভাবিক। সভ্যতার মিশনের প্রধান দাবি ছিল জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস। কলোনির সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থার বিপরীতে ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে উচ্চতর বলে গণ্য করা হয়েছিল, অতএব কলোনির জনগণকে ইউরোপীয় সভ্যতার স্তরে পৌঁছানোর জন্যই উপনিবেশ স্থাপনকে দরকারি কাজ হিশাবে দেখা হয়েছিল।

‘সভ্যতার মিশন’ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণকে ন্যায্য বলে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করে। পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক শক্তির প্রধান দায় ও কর্তব্য হচ্ছে এশিয়া,আফ্রিকা ও আমেরিকার স্থানীয় বর্বর অধিবাসীদের সভ্য করা, অধর্ম থেকে উদ্ধার করে তাদের যীশুর ধর্মে ধর্মান্তরিত করা এবং তাদের শিক্ষা দেওয়া যেন তারা ইংরেজের মতো ভাবতে পারে। কলোনির লুটতরাজ ও অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর কলোনিয়াল শাসন কায়েমের পক্ষে ‘সভ্যতার মিশন’ ছিল গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি। জে আর সিলি (J.R. Seeley) The Expansion of England বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠিকে শাসন করবার জন্য কেন ইংরেজই সবচেয়ে উপযুক্ত জাতি (Seeley 1883) ।

জে আর সিলি ও সভ্যতার মিশন তত্ত্বের সমর্থকরা জন ওয়াল্টার দ্বিতীয় এবং তাঁর ছেলে জন ওয়াল্টার তৃতীয়ের পত্রিকা The Times-এ লিখতেন। পত্রিকার প্রতাপ ও প্রভাব কার্যকর রাখার ক্ষেত্রে ওয়াল্টার পরিবারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ১৮০৩ থেকে ১৮৪৭ তারিখ অবধি জন ওয়াল্টার দ্বিতীয় পত্রিকার ব্যবস্থাপনায় ছিলেন, এরপর জন ওয়াল্টার তৃতীয় ১৮৯৪ সাল অবধি পত্রিকা চালান। পাশাপাশি জে আর সিলির বই প্রকাশ করতো ড্যানিয়েল ও আলেক্সান্ডার ম্যাকমিলান পরিবারের ম্যাকমিলান পাবলিশার। সিলির বিখ্যাত বই The Expansion of England ছাপা হয় ১৮৮৩। দ্য টাইমস এবং ম্যাকমিলান ইংরেজ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকদের চিন্তা প্রকাশ, প্রচার ও ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ঔপনিবেশিক শক্তি ঔপনিবেশিকতাকে ন্যায্য এবং পদানত জনগোষ্ঠির জন্য মঙ্গল বলে ক্রমাগত প্রচার করেছে। অসভ্য বা বর্বরদের সভ্য করবার উত্তম ব্যবস্থা হিশাবে যুক্তি দিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঔপনিবেশিক বয়ান ও প্রপাগান্ডা সে ক্ষেত্রে খুবই সফল। এই সফলতা আত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক ভাবে কলোনির গণমানসে এত গভীর ও প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, আমরা বাতচিত করি বটে, কিন্তু আসলে আমাদের মধ্যে গেঁড়ে বসা ‘সভ্যতার মিশন’ তত্ত্ব কত গভীর ও দুরারোগ্য সে সম্পর্কে আমরা আদৌ সচেতন ও সজ্ঞান নই। দীর্ঘ ও কঠিন বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বি-উপনিবাশয়নের লড়াই ছাড়া নিজেদের ইতিহাস নির্মাণের জন্য নিজেদের স্বাধীন কর্তা হিশাবে তৈয়ার এবং বিশ্ব ইতিহাসে প্রবেশ সম্ভব নয়। ঔপনিবেশিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা আমাদের এতো গভীর ভাবে প্রোথিত যে ‘সভ্যতা/অসভ্যতা’, ‘শিক্ষা/অশিক্ষা’, ‘আধুনিকতা/অনাধুনিকতা, ‘প্রগতি/পশ্চাতপদতা’ ইত্যাদি বাইনারি ঔপনিবেশিক ইংরেজ বা ইউরোপকে আদর্শ জ্ঞান করেই আমরা ভাবি। অর্থাৎ ইংরেজ বা ইউরোপ সভ্য, আধুনিক ও অগ্রসর, আমরা অসভ্য, বর্বর ও পশ্চাৎপদ। অতএব আমাদের অগসর হতে হলে ইউরোপকেই, কিম্বা সাম্রাজ্যবাদী যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থাকেই আদর্শ হিশাবে মানতে হবে।

এই ঔপনিবেশিক কালপর্ব আমরা মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কিম্বা সাংস্কৃতিকভাবে অতিক্রম করেছি বলা যাবে না। আমাদের জাতিবাদি বয়ানে ‘বাঙালি’ হওয়া আপাদমস্তক রোমান্টিক কিম্বা যা আমরা আর কখনো হব না বা হতে চাই না, তার জন্য মধুর হাহাকারের অধিক কিছু না। আমরা মনে মনে নিশ্চিত সেটা আর সম্ভব না। আমাদের পাশ্চাত্য প্রীতি হচ্ছে মেরেছো কলসির কানা , তাই বলে কি প্রেম দেব না জতীয় বৈশ্বিক আখ্যান। তাই কলোনিয়ালিজম বিরোধী জাতিবাদি বয়ান আমাদের বাহ্যিক রাজনৈতিক স্বাধীনিতা দিয়েছে কিন্তু মর্মে রয়েছে নিজেদের ইংরেজ বা ইউরোপীয় করে তোলার বাসনা। সভ্য হওয়া মানে ইংরেজ বা ইউরোপীয় হওয়া। কলোনির গণমানসে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়ে রয়েছে তার চিকিৎসা অতো সহজ নয়। জনসাধারণের ধ্যানধারণা পরিগঠনের মধ্য দিয়েই গণমাধ্যম ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে অনুকুল মনোভাব সৃষ্টি করেছে। সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া এবং ঔপনিবেশিক নীতি, মতাদর্শ ও আইনকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

‘সভ্য করবার মিশন’ আসলেই একটি অপ্রতিরোধ্য কেন্দ্রীয় ঔপনিবেশিক প্রকল্প। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদি শক্তির দ্বারা অ-ইউরোপীয় সমাজে উপনিবেশ এবং অ-ইউরোপীয়দের ওপর আধিপত্য কায়েমকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এ মতাদর্শটি দাবি করে তথাকথিত ‘অনগ্রসর’ জনগণের কাছে সভ্যতা, অগ্রগতি এবং ‘আলোক’ বিতরণ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির দায়িত্ব। ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা তাদের প্রচেষ্টাকে খ্রিষ্টধর্ম এবং পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ প্রচেষ্টা গণ্য করে। উপনিবেশ স্থাপন ছিল ধর্ম প্রচারের জন্য জরুরি। উপনিবেশের জনগণের প্রতি ধর্মীয় দরদের মধ্যেও জনগণকে শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং স্ব-শাসনে অক্ষম হিসাবে পর্যবসিত করা হয়। সেই দরদের যুক্তিতে পরাধীন জনগোষ্ঠির অভিভাবক হয়ে তাদের উপকার করবার বাসনাও সিভিলাইজিং মিশনের অন্তর্গত। ঔপনিবেশিক পরোপকার ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার পক্ষে বয়ান তৈরি এবং ঔপনিবেশিক শক্তিকে ন্যায্য বলে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা মাত্র (Thomas 1994) ।

ঔপনিবেশিক শক্তি ইউরোপের বাইরে সভ্যতা বিতরণ করেছে এই অনুমান থেকে কার্ল মার্কসও পুরাপুরি মুক্ত ছিলেন না। তবে একে অনেকে যেভাবে ‘ইউরোকেন্দ্রিকতা’ (Eurocentrism) বলে থাকেন বিষয়টি অতো সরল নয়। অনড় ‘বর্বর’ জনগণকে ঔপনিবেশিক শক্তি ‘সভ্য’ করেছে সেটা মার্কসের দাবি ছিল না। মার্কস পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ককে সামন্ত বা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক নিশ্চল অর্থনৈতিক সম্পর্কের তুলনায় গতিশীল মনে করতেন। তাঁর দাবি ঔপনিবেশিক শক্তির ধ্বংসাত্মক ও বিনাশী কর্মকাণ্ড উপনিবেশিত জনগোষ্ঠির গতিহীন সমাজকে সচলতা দিয়েছে। এখানে যে দার্শনিক অনুমান রয়েছে সেটা হোল, ভাঙন ছাড়া নতুন কিছু গড়ে তোলা অসম্ভব। এশীয় সামন্ত ব্যবস্থা ভেতর থেকে নিজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে না ভাঙলেও বাইরের ঔপনিবেশিক শক্তি সেই ভাঙাগড়া সম্পন্ন করেছে। ঔপনিবেশিকতার মধ্যে যে প্রগাঢ় ধারণা বদ্ধমূল যে, কলোনির অ-ইউরোপীয় সমাজগুলি স্ব-শাসনে অক্ষম, ফলে ইংরেজ বা ইউরোপীয়রা তাদের শাসক হবে এটা যৌক্তিক ও ন্যায্য –এটা মার্কসের দাবি ছিল না। এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা প্রবলভাবে এখনও বাংলাদেশের মতো প্রাক্তন ব্রিটিশ কলোনিতে রয়েছে। তার প্রকাশটা ইন্টারেস্টিং। যেমন, শ্রেণি নির্বিশেষে আমরা মনে করি – আমরা আমাদের দেশ কিম্বা রাষ্ট্র নিজেরা ‘গঠন’ করতে পারব না। এমনকি আমাদের নির্বাচনও ঠিকভাবে করতে হলে বিদেশি সহায়তা লাগবে। আমরা পারব না, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ঠিক করে দেবে, কেবল তখন আমরা ফ্যাসিস্ট শাসক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাব।

পর্তুগিজ, ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা ছিল কয়েক কাঠি চড়া। তারা খ্রিষ্টধর্ম প্রচার এবং বর্বরদের পাপ থেকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রবলভাবে নিয়োজিত ছিলেন এবং পশ্চিমা নৈতিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়াকে তাদের ধর্মীয় দায় গণ্য করতেন। কলোনির মানুষগুলোকে আদিপাপ থেকে মুক্তি দেওয়া খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি পালন ভাবা হতো (Thomas 1994) ।

জাতিগত ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস ছিল ঔপনিবেশিক ন্যায্যতার আরেকটি ভিত্তি। পাশ্চাত্য গণমাধ্যমগুলো অ-ইউরোপীয় জনগণকে বর্ণগতভাবে নিকৃষ্ট এবং সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চাদপদ গণ্য করত এবং সেভাবেই গণমাধ্যমে তাদের হাজির করা হতো। এই দাবিগুলির পক্ষে ছদ্ম বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও যুক্তিতর্কও ব্যবহার করা হতো। অনেক মিডিয়া সামাজিক ডারউইনবাদকে তাদের যুক্তির পক্ষে ব্যবহার করত। এর দ্বারা অনায়াসে প্রমাণ করা যেত যে, ইউরোপীয় আধিপত্য আসলে ‘যোগ্যতমের বেঁচে থাকা’ অতি স্বাভাবিক এবং অনিবার্য পরিণতি। যারা প্রতিযোগিতায় পাশ্চাত্যের সঙ্গে পারছে না বা হেরে গিয়েছে তারা পাশ্চাত্যের অধীনতা মেনে নেবে এটাই স্বাভাবিক (MacKenzie 2003) ।