দিল্লিতে ‘আটকে আছে’ সালাহউদ্দিনের ঢাকা ফেরা

সালাহউদ্দিন আহমেদ।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শিলং শহরে অবস্থানরত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে বাংলাদেশে ফেরাতে আদালতের নির্দেশনা উল্লেখ করে মেঘালয় সরকার দিল্লির সাউথ ব্লকে চিঠি দিলেও এক বছরেও অনুমতি মেলেনি।

গত বছরের ২৪ মার্চ তারিখে শিলং থেকে পাঠানো চিঠির একটি অনুলিপি দ্য মিরর এশিয়ার প্রতিবেদক দেখেছেন।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের অনুরোধেই প্রধান বিরোধী দলের স্থায়ী কমিটির এই সদস্যকে ভারত ফেরত পাঠাচ্ছে না বলে দ্য মিরর এশিয়াকে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট কূটনীতিক সূত্র। দুই প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং উভয় দেশের সম্মতি ছাড়া দিল্লি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না।

মেঘালয়ের রাজধানী শিলং আদালতের ফাস্ট ক্লাস কোর্টের ২০১৮ ও ২০২৩ সালের দুটি নির্দেশনা উল্লেখ করে গত বছরের ২৪ মার্চ সাউথ ব্লকের বাংলাদেশ ও বার্মা ডেস্কের কর্মকর্তা দীপক খাত্রিকে চিঠি পাঠান মেঘালয় রাজ্য সরকারের যুগ্ম সচিব শ্রীমতি সাংমা।

চিঠিতে, শিলং আদালতের দুটি নির্দেশনা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট দপ্ততের অনুমোদন সাপেক্ষে বাংলাদেশের হাই প্রোফাইল নাগরিক সালাউদ্দিন আহমেদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করতে বলা হয়েছে।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত থেকে খালাস পাওয়ার পর সালাহউদ্দিন আহমেদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া শুরু করেন। বিদেশে থেকেও দলের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

সালাহউদ্দিন আহমেদ একটি গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো দিল্লি সরকার তাকে ছাড়পত্র দিচ্ছে না। এ ছাড়া আর কী হতে পারে! কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন না পেলে মেঘালয় রাজ্য সরকার কোনো বিদেশিকে এভাবে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিতে পারবে না। দেশে ফেরা এখন সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।

বিএনপির এই নেতা বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে আমার দেশে ফেরা সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশে ফেরা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। এখানে আমার হাতে কিছুই নেই।

সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনকালে ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সাবেক এই যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীকে। দীর্ঘ ৬২ দিন পর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। তখন থেকে তিনি সেখানেই আছেন।

দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেঘালয়ের শিলংয়ে স্থানীয় পুলিশ সালাহউদ্দিনকে উদ্ধারের পর সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করে এবং বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের অভিযোগে ফরেনার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার দেখায়। একই বছরের ২২ জুলাই ভারতের নিম্ন আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের দায়ে অভিযোগ গঠন করা হয়।

প্রায় সাড়ে তিন বছর মামলার কার্যক্রম চলার পর ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে করা মামলায় আদালত নির্দোষ সাব্যস্ত করে খালাস দেন সালাহউদ্দিন আহমেদকে। ৬ মাস পরে আবার ভারত সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। আবারও প্রায় চার বছর সময় ক্ষেপণের পরে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় তিনি শিলং জজকোর্ট থেকে খালাস পান এবং তাকে দ্রুত সময়ে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

তবে পাসপোর্ট না থাকায় সালাহউদ্দিন আহমেদ পরে দেশে ফিরতে ট্রাভেল পারমিটের জন্য গৌহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে আবেদন করেন। পরে পাসপোর্টের বিকল্প হিসেবে গত বছরের জুনে হাইকমিশন থেকে তাকে তিন মাসের ট্রাভেল পাস দেওয়া হয়। তবে এই ট্রাভেল পাস দিয়ে তার ভারতের ইমিগ্রেশন পার হওয়া সম্ভব নয়।

এদিকে, আদালতের রায় সংযুক্ত করে মেঘালয় সরকার এ বিষয়ে গত বছরের ২৪ মার্চ দিল্লি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সালাহউদ্দিনকে দেশে ফেরত পাঠাতে ছাড়পত্রের জন্য চিঠি দিয়েছিল। এর আগে ২০১৮ সালে যখন ভারতের বিচারিক আদালত থেকে তিনি রায় পেয়েছিলেন, তখনও মেঘালয় সরকার এভাবে চিঠি দিয়েছিল। তবে তখনও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জবাব দেয়নি।

গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন করছিল, তখন দলের মহাসচিবসহ অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আত্মগোপনে থেকে দলের মুখপাত্র হিসেবে বিবৃতি দিতেন, গণমাধ্যমে কথা বলতেন। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে তিনি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন।

বিএনপি তখন অভিযোগ করে, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সালাহউদ্দিন আহমদকে তুলে নিয়ে গেছে। এর ৬২ দিন পর ১১ মে সিলেটের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের মেঘালয়ে শিলংয়ের পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। তখন ভারতের পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সালাহউদ্দিন শিলংয়ে উদভ্রান্তের মতো ঘোরাঘুরি করার সময় লোকজনের ফোন পেয়ে তাকে আটক করা হয়।

বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের অভিযোগে ফরেনার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার দেখায় সেখানকার পুলিশ। পরে সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা এবং পরে অভিযোগ গঠন করা হয়।

কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ পরবর্তী সময়ে সংগঠনের সহসভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। সপ্তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে বগুড়ায় কর্মরত থাকাবস্থায় তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন। পরে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি কক্সবাজার-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

চার দলীয় জোট সরকারের যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি একাধারে কক্সবাজার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবং দু’বার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। ২০১০ সালে দলের কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ২০১৬ সালের কাউন্সিলে তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।