বিতর্ক মার্কিন নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলে?

বিতর্ক মার্কিন নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলে?

আগামী নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে লড়বেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আর রিপাবলিকান পার্টির হয়ে লড়বেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাতে (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকাল সাতটায়) সিএনএনের আটলান্টা স্টুডিওতে বিতর্কে অংশ নেন বাইডেন ও ট্রাম্প। নির্বাচনের আগে তারা প্রথম মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নিলেন।

তবে এ বিতর্ক ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে কিনা, কী ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং সেটা কার জন্য অনুকূল হবে— সেটাই প্রশ্ন।

প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের বিতর্ক, বিশেষ করে প্রথম বিতর্ক, একটা বড় ধরনের টেলিভিশন ইভেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের মধ্যকার প্রথম বিতর্কের দর্শক ছিল ৮ কোটি ৪০ লাখ। ১৯৬০ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে যতগুলো টেলিভিশন বিতর্ক হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর্শক হয়েছিল ২০১৬ সালের এই বিতর্কে। এ বছর এ সংখ্যা আরো বেশি হবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। তার কারণ একাধিক। করোনাভাইরাসের কারণে ভোটাররা অন্য সময়ে প্রার্থীদের যতটা দেখতে ও শুনতে পারেন, এ বছর তা হয়নি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে মেরুকরণ ঘটেছে আগের চেয়ে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

কেনেডি ও রিচার্ড নিক্সন

১৯৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিতর্কে মুখোমুখি হয়েছিলেন জন এফ কেনেডি ও রিচার্ড নিক্সন। ভোটারদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি গড়তে এই বিতর্ক যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তা তখন প্রতিষ্ঠিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিতর্কে মুখোমুখি হয়েছিলেন জন এফ কেনেডি ও রিচার্ড নিক্সন।

দেশটির দুবারের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক্সন নির্বাচনে জয়ী হবেন বলে বিতর্কের আগে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু বিতর্ক তার জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। টেলিভিশনের পর্দায় আসার আগে নিক্সন মেকআপ নিতে অস্বীকৃতি জানান। ৬ কোটি ৬০ লাখ দর্শকের সামনে তাকে বেশ ফ্যাকাশে ও ঘর্মাক্ত দেখায়।

নিক্সনের বিপরীতে টেলিভিশনের পর্দায় ম্যাসাচুসেটসের তরুণ সিনেটর কেনেডিকে বেশ ঝাঁ–চকচকে ও ফুরফুরে দেখা যায়। নিক্সন বারবার উপস্থাপকের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তাকে উদ্দেশ করে কথা বলছিলেন। কিন্তু কেনেডির দৃষ্টি ছিল সরাসরি ক্যামেরার দিকে। ক্যামেরায় ভোটারদের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের মনোভাব জানিয়ে দিয়েছিলেন। বিতর্কের প্রভাব পড়েছিল ব্যালট বাক্সে। রিপাবলিকান নিক্সনকে হারিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের কেনেডি।

ফোর্ড-কার্টার

১৯৮৪ সালের ২১ অক্টোবর বিতর্কে মুখোমুখি হন রিপাবলিকান রোনাল্ড রিগ্যান ও ডেমোক্র্যাট ওয়াল্টার মন্ডেল।  তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের বয়স তখন ৭৩ বছর আর মন্ডেলের ৫৬। বয়স নিয়ে মজার উত্তর দিয়ে বিতর্কের মোড় নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন রিগ্যান।

বয়সের কথা উল্লেখ করে রিগ্যানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তিনি পুরোপুরি উপযুক্ত কি না? জবাবে মজার ছলে রিগ্যান বলেছিলেন, তিনি তার প্রতিপক্ষের তারুণ্য ও অনভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন না। এমন উত্তর ভোটারদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন রিগ্যান।

ওবামা-রমনি

বারাক ওবামা ও মিট রমনি বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন ২০১২ সালের ২২ অক্টোবর। এতে রিপাবলিকান রমনি বলেছিলেন, ১৯১৬ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর যত জাহাজ ছিল, এখন তার চেয়ে কম আছে।

রমনির এই বক্তব্য লুফে নেন ওবামা। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে ঘোড়া ও বেয়নেটও কম আছে। কেননা, আমাদের সামরিক বাহিনীর ধরনই বদলে গেছে। আমাদের আছে বিমানবাহী রণতরি। এতে উড়োজাহাজ অবতরণ করে। আছে জলের তলে চলাচলকারী পারমাণবিক সাবমেরিন।’ওবামার এ বক্তব্য অনলাইনে ভাইরাল হয়ে যায় আর নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট হন ওবামা।

তবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের সহকারী অধ্যাপক ভিনসেন্ট পন্স এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের পিএইচডি শিক্ষার্থী ক্যারোলাইন লা পেনেক-কেলদোচৌরি ১৯৫২ সাল থেকে ৯টি দেশের ৬১টি নির্বাচনে ভোটাররা কখন প্রার্থীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন এবং তাদের ওপর টেলিভিশন বিতর্ক কতটা প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে গবেষণা করেছেন। 

নির্বাচনের আগে ও পরে ১ লাখ ৭২ হাজার ভোটারের ওপর করা সব জরিপ তারা বিশ্লেষণ করেছেন, এর ৮০ শতাংশ বিতর্ক দেখেছেন। কিন্তু ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত তাদের গবেষণার ফলাফল হচ্ছে, বিতর্ক নির্বাচনের ফলাফলে কোনো প্রভাব রাখেনি। এমনকি বয়সে তরুণ এবং যারা নির্বাচন বিষয়ে কম খোঁজখবর রাখেন, তাদের পছন্দ বদলাতে পারেনি।

বিতর্ক প্রভাব ফেলে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মার্কিন নাগরিকেরা টেলিভিশন ইভেন্ট হিসেবে হলেও বিতর্ক দেখতে চান, সেটা অনস্বীকার্য। প্রভাব বিস্তার করতে পারার অতীতের ধারাবাহিকতা এবারো থাকবে নাকি ভিন্ন রকম কিছু দেখা যাবে, সেটা আমরা পরে জানতে পারব। তবে যদি এই বিতর্কে অতীতের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকে, তবে তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য সুসংবাদই হবে। কেননা এখন পর্যন্ত জাতীয় জনমত জরিপে তিনি এগিয়ে এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজ্যগুলোর অধিকাংশেই তিনি হয় এগিয়ে আছেন, নতুবা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে।