ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়র লিটনের রহস্যময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং তার মেয়ে আনিকা ফারিহা জামান অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। রাজধানীর অভিজাত এলাকা খ্যাত বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের আতাতুর্ক টাউয়ারের সপ্তম তলা থেকে তারা এই ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।

তবে আতাতুর্ক টাওয়ারে এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোনো সাইনবোর্ড নেই। ওই অফিসে প্রবেশের পর এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সেখান থেকে চারটি শিপিং কোম্পানি পরিচালিত হচ্ছে। সেগুলো হলো- সিবন্ড শিপিং লিমিটেড, সুলতানগঞ্জ পোর্ট পিএলসি, ইন্দো বাংলা লাইনস পিএলসি এবং পদ্মা ডিস্ট্রিপার্ক পিএলসি।এসব কোম্পানির ওয়েবসাইটেও একই অফিস ঠিকানা দেওয়া হয়েছে।

ওই অফিসের দুজন বলেছেন, এই অফিস চলে মোহাম্মদ আলমগীর আখতার সরদার নামক এক ভারতীয় নাগরিকের নির্দেশে; তিনিই মূলত এই অফিস নিয়ন্ত্রণ করেন। আলমগীর আখতার নিজেকে ড. এমএএ সরদার বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তবে শিপিং ব্যবসার কথা বলা হলেও ওই অফিসে এই ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো কিছু চোখে পড়েনি।

যৌথ মূলধনী কোম্পানির রেজিস্ট্রার দপ্তরের তথ্যমতে, আলমগীর আখতার সরদার মূলত সিবন্ড শিপিং লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডারদের তালিকায় থাকা পেলাগিন লাইনস লিমিটেডের প্রতিনিধি। যা আবার লিটন ও তার মেয়ের কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নানা কায়দায়। সেখানে আলমগীর সরদারের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে- ১০/১, দশম তলা, সিটি হার্ট, ৬৭, নয়াপল্টন, ঢাকা।

মেয়র লিটনের পরিবারে আলাদিনের চেরাগ-১: এক বছরেই ছয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা

ওই অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, আলমগীর আখতার সরদার প্রায় দুই বছর ধরে তার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার বনানীর একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। আলমগীরের স্ত্রী একজন পাকিস্তানি নাগরিক। তবে আলগীরের বাংলাদেশে ওয়ার্ক পারমিট নেই বলে নিশ্চিত করেছেন ওই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে আলমগীরকে মোবাইল ফোনে কল দিয়েছিল দ্য মিরর এশিয়া। প্রথমে তিনি দাবি করেন, এখানে বৈধভাবে কাজ করার জন্য সব ধরনের কাগজপত্র তার কাছে রয়েছে। দ্য মিরর এশিয়া সেগুলো দেখতে চাইলে তিনি তখন ভোল পাল্টে বলেন, তার ওয়ার্ক পারমিটের প্রয়োজন নেই। কারণ, এখানে যিনি আলগীরের ব্যবসায়িক অংশীদার তার সব ধরনের অনুমোদন রয়েছে।

কে এই আলমগীর সর্দার

ভারতের মিনিস্ট্রি অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্সের (আইএমসিএ) তথ্যমতে, আলমগীর আখতার সরদার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার বশিরহাট এলাকার বাসিন্দা। তার কোম্পানি ডিরেক্টর আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ডিআইএন) হলো ০২৪৬৬১০৯। ২০০৯ সালে আলী আসকার কোরাইশি ও আনোয়ার আলি মোল্লা নামে দুজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কলকাতার ৪৭ পার্ক স্ট্রিটে ফেয়ারল্যান্ড নামে একটি শিপিং কোম্পানি চালু করেন। ২০১০ সালে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের জন্য আলমগীরকে ওই কোম্পানি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আলমগীর আখতার সরদার নেপাল, পাকিস্তান ও দুবাইয়ে শিপিং ব্যবসা শুরু করেন। দুবাইয়ে বসবাসরত পাকিস্তানি নাগরিক জাফর হাবিব ও তার ভাই ইমরান হাবিবকে সঙ্গে নিয়ে আলমগীর যুক্তরাজ্যে একটি অফশোর কোম্পানি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি হাউস আফ্রো এশিয়া লাইনস লিমিটেড নামের ওই কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১৭ সালে আলমগীর কলকাতায় একই নামে একটি শিপিং কোম্পানি খোলেন। ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে ভারতে ৯টি শিপিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে ভারতে তিনি রিভার এজ শিপিং প্রাইভেট লিমিটেড পরিচালনা করেন। অন্যদিকে, জাফর হাবিব দুবাই ও পাকিস্তানে একই কোম্পানি পরিচালনা করেন।

নেপাল ও ভারতের কলকাতায় আলমগীর সরদারের দুই প্রাক্তন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে খুঁজে পেয়েছে দ্য মিরর এশিয়া। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলমগীর দীর্ঘদিন ধরে শিপিং ব্যবসার আড়ালে ট্রেড বেসড মানি লন্ডারিং (টিবিএমএল) করে আসছেন। এজন্য তিনি জায়গায় জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন নামে অসংখ্য শিপিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। যার মাধ্যমে টিবিএমএল আন্ডার বা ওভার ইনভয়েসিং করা হয়।

আরও পড়ুন: লিটন আর দুর্নীতি যেন একই সূত্রে গাঁথা

২০১৮ সালে আলমগীর সরদার যখন রিভার এজ শিপিং প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তার অংশীদার ছিলেন নেপালের প্রভু গ্রুপের চেয়ারম্যান ও দেশটির রাজনীতিবিদ দেবী প্রকাশ ভট্টাচান। ২০২১ সালে ভট্টাচান রিভার এজের পরিচালক পদ থেকে সরে দাঁড়ান। প্রভু গ্রুপের মালিকানাধীন প্রভু মানি ট্রান্সফার লিমিটেড নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সক্রিয়। তারা নেপালে প্রভু ব্যাংকও প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্প্রতি নেপালের মনিটারি রেগুলেটরি অথরিটি মানি লন্ডারিং অ্যাক্টের বিধান না মেনে চলায় ওেই ব্যাংককে জরিমানা করেছে৷ এছাড়াও, প্রভু ব্যাংককে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে নেতিবাচক ইম্প্রেশন রেটিং দেওয়ার পাশাপাশি তাদের কার্যক্রম নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

লিটনের পরিবারের সঙ্গে আলগীরের সম্পৃক্ততা কীভাবে

আলমগীর আখতার সরদার প্রথমে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবুল হোসেন ও তার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। দুর্নীতির দায়ে ২০১৮ সালে আবুল হোসেনকে বিজিবির মহাপরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় তার বিরুদ্ধে বিজিবি মার্কেট নির্মাণ ও সেখানকার দোকান বরাদ্দে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

একাধিক সূত্র থেকে দ্য মিরর এশিয়া নিশ্চিত হয়েছে যে, বিজিবির ডিজি থাকাকালে আবুল হোসেন ভারতের একটি সংগঠিত চোরাচালান চক্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ওই চক্রের কয়েকজনের সঙ্গে আলমগীর আখতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এখান থেকেই মূূলত আলমগীর ও আবুল হোসেনের পরিচয়। এরপর তারা একই কায়দায় বাংলাদেশে শিপিং ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করেন এবং তারা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

এরপর বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে ভারতের মায়া পর্যন্ত নৌপথ খুলে সুলতানগঞ্জে বন্দর স্থাপনের সরকারি গেজেট প্রকাশের আগেই আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে একটি বেসরকারি বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দেন আলমগীর সরদার ও আবুল হোসেন। সেই প্রস্তাব নিয়েই তারা বিভিন্ন নামে একের পর এক শিপিং কোম্পানি খুলতে থাকেন। একইসঙ্গে লিটন পরিবারের পুরনো ব্যবসায়িক অংশীদার আমানা গ্রুপ ও শামসুজ্জামান আউয়াল এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল। এসব শিপিং কোম্পানি চালুর প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আমানা গ্রুপ ব্রিটেনে বেশ কিছু কোম্পানি খুলেছিল, যা এখনও রহস্যে ঘেরা। বাংলাদেশে একই পদ্ধতিতে শিপিং কোম্পানি গড়ে তুলতে আবুল হোসেনের সঙ্গে যোগ দেন আমানা গ্রুপ।

রাজশাহী-মায়া নৌপথ পুনরায় চালু করার পক্ষে কথা বলছেন- এমন একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য মিরর এশিয়া। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওই ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রথম দিকে খায়রুজ্জামান লিটন তাকে একটি বন্দর কোম্পানি চালুর প্রস্তাব দিয়েছলেন। পরবর্তীতে এ প্রক্রিয়ায় ভারতীয় নাগরিক আলমগীর সরদার ও বিজিবির সাবেক ডিজি আবুল হোসেন ঢুকে পড়েন। পরে তারা নিজেরাই একের পর এক শিপিং কোম্পানি খুলতে থাকেন।

ওই ব্যবসায়ীর মতে, খায়রুজ্জামান লিটন ও তার সঙ্গীরা যেভাবে শিপিং কোম্পনি খুলে বসছেন, দেখে মনে হয় না তারা শুধু বন্দর প্রতিষ্ঠা কিংবা শিপিং ব্যবসা করতে চান না।

তাহলে তাদের উদ্দেশ্য কী হতে পারে, এমন প্রশ্নে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটি অনেক বড় কিছু।’

অনেকটা হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘তাদের অসৎ মতলব আছে। কারণ সদ্য শুরু হওয়া ছোট এই বন্দরে কখনোই ব্যবসা হবে না। বন্দরকে ব্যবহার করে অন্য কোনো ব্যবসা করাই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু এগুলো নিয়ে কথা বললে আপনি প্রাণে বাঁচতে পারবেন না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল হোসেন মোবাইল ফোনে দাবি করেন, তারা সব নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) হঠাৎ কেন আমাদের নিয়ে পড়লেন তা বুঝতে পারছি না।’

আলমগীর সরদার ও মেয়র লিটনের সঙ্গে তার যোগসাজশ এবং বিদেশে রহস্যময় কোম্পানি খোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কল কেটে দেন। এরপর বারবার চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

গত দুইদিন ধরে বেশ কয়েবার খায়রুজ্জামান লিটনের মোবাইল ফোনে কল দিয়েছে দ্য মিরর এশিয়া তবে তিনি রিসিভ করেননি।

আরও পড়ুন: এক বছরেই ছয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা 

আরও পড়ুন: লিটন আর দুর্নীতি যেন একই সূত্রে গাঁথা